শহীদুল্লাহ সুমন ::: বরগুনার আমতলী বন্দর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন খানের বিরুদ্ধে পরীক্ষার খাতা শিক্ষার্থীদের না দেখানো, কোচিং বাণিজ্য, গাইড বই বাণিজ্য, প্রাইভেট না পড়লে ইচ্ছাকৃতভাবে রেজাল্ট খারাপ করিয়ে দেওয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে- আমতলী বন্দর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জাকির হোসেন খান বিগত ২০১৪ সালের ১৫ জুন ওই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ওই বিদ্যালয়ে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জিল্লুর হোসেনকে তার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক মেয়র নাজমুল আহসান নান্নুর প্রভাব খাটিয়ে ভোলার মনপুরায় বদলী করে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। তখন তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সুশীল সমাজ মানববন্ধন করেছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কারণে তিনি অদ্যবধি এই বিদ্যালয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ১০ বছরের অধিক সময় একই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে থাকার কারণে তার আচরণ স্বেচ্ছাচারিতায় রুপ নিয়েছে বলে অভিযোগ সহকারি শিক্ষকদের। প্রধান শিক্ষক মোঃ জাকির হোসেন খান ও ডেপুটেশনে যোগদানকৃত শিক্ষক মাঈনুল ইসলাম দুজনে মিলে আলাদা আলাদা বাসায় কোচিং সেন্টার খুলে মাসে লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। প্রধান শিক্ষকের বাসায় কোচিং ফি মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা আর মাইনুল ইসলামের বাসার কোচিং ফি ৩ হাজার টাকা। সেখানে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে পড়ানো হয়। এমনকি ওই বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার শাহিনুর আক্তারের ছেলে সামিরও পড়েন। এরআগে মাইনুল ইসলামকে তার এক নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে আমতলী এ কে হাই সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তর পূর্ব চিলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করলেও কয়েক দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ইশারায় আমতলী বন্দর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন বলে অভিযোগ অন্যান্য শিক্ষকদের। শিক্ষকদের কোন বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের মতের অমিল হলে সেই শিক্ষকের বিভিন্ন ভাবে নাজেহাল হতে হয়। এ কারণেই তার ভয়ে কেউ মূলতে সাহস পায় না।
আরও জানা গেছে- বছরের শুরুতেই গাইড বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন প্রধান শিক্ষক মোঃ জাকির হোসেন খান। তিনি ‘লেকচার গাইড’ রেখে স্কুলেই বিক্রি করছেন। এমন একটি ভিডিও প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। এদিকে বার্ষিক ভোজনে শিক্ষার্থীদের সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় গেছেন প্রধান শিক্ষক। সে জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা নিয়েছেন। আর শিক্ষকদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৫০০ টাকা। বিদ্যালয়ে একজন ঝাড়ুদার রেখে তাকে প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা করে বছরে ৩৬ হাজার টাকা দেয়া হলেও বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৩০০ করে প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকা আদায় করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর খাতা শিক্ষার্থীদের না দেখানো হয় বলে অভিযোগ শীক্ষার্থীদের। অপরদিকে প্রাইভেট না পড়লে ইচ্ছাকৃতভাবে রেজাল্ট খারাপ করিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। এ কারণে ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান দিন দিন কমছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার মেয়ে বিজ্ঞানে কম নম্বর পাওয়ার পর আমাকে বলে, আমি প্রাইভেট পড়ি না বলেই আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে কম নম্বর দিয়েছে। তুমি তো আমাকে স্কুল টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়তে দাও না। এজন্যই আজ এ অবস্থা। পরবর্তীতে আমি শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ভুলে ৮৬ নম্বর পেলেও রেজাল্ট কার্ডে ৭৫ নম্বর উঠানো হয়েছে।
আরেক অভিভাবক বলেন, এই প্রধান শিক্ষক দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অনিয়মকে নিয়মে পরিনত করেছে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যে উৎসাহিত করেছে। একজন শিক্ষক যদি পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে শিক্ষার্থীদের একই সঙ্গে প্রাইভেট পড়াতে পারে এবং তাদের সকল খাতা দেখতে পারে, তবে শ্রেণিকক্ষে কেন পারবে না। প্রাইভেট পড়লেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল ভালো হবে আর না পড়লে তাদের ফলাফল পেছনের দিকে থাকবে এ সংস্কৃতি দূর করতে হবে। এটা অনেকটাই এরকম প্রমাণের চেষ্টা করা, তোমরা আমাদের কাছে জিম্মি। তোমাদের সঙ্গে আমরা যা খুশি তাই করতে পারি।
চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষকরা ছাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। অনেক সময় অভিভাবকদের সঙ্গেও ফোনে খারাপ আচরণ করেন। এই বিদ্যাপীঠে প্রধান শিক্ষক লেকচার গাইড বিক্রি করেন। মূল বই কখনোই পড়ানো হয় না। শিক্ষকরা যাকে খুশি প্রথম বানাচ্ছে যাকে খুশি শেষ বানাচ্ছে। শিক্ষকদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে শিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছে গেছে। এই বিদ্যালয়টি কখনোই শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠান ছিল না, এটি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ডেপুটেশনে যোগদানকৃত শিক্ষক মাঈনুল ইসলাম বলেন- সবাই কোচিং করায়, আমি করালে দোষ কি? আমার এখানে মাত্র ৭/৮ পড়ে। অন্যান্যরাও পড়ায় তাদের গিয়ে ধরেন।
এপ্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন খান বলেন- আমতলীতে কোচিং সবাই করায়। আমি লাভের আশায় নয়, সেবার জন্য কোচিং চালু করেছি। বিগত ৮ মাস লোকসান হয়েছে, এখন কিছুটা লাভ হচ্ছে। আপনি (প্রতিবেদক) আমতলীতে আসেন আপনাকে নিয়ে সব কোচিং বন্ধ করবো। গাইড বইয়ের বিষয়টি সত্য নয়। আপনি আইসেন আপনার সাথে কথা আছে। সব কথাতো ফোনে বলা যায় না।
এ বিষয়ে ওই বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার শাহিনুর আক্তার মুঠোফোনে বলেন- গাইড বইয়ের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে তিনি কোচিং বাণিজ্য করে না অনেক অভিবাবক চায় তাই তার বাসায় শিক্ষার্থীদের পড়ান। অনত্র পড়াতে বেশি খরচ হয়, ওখানে কম খরচে পড়াতে পারে তাই অভিবাবকদের কথার ভিত্তিতে তিনি কোচিং করাচ্ছেন।
কোচিং করানো কোন বিধান রয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন- দেখতে হবে, বিষয়টি আমার সঠিক জানা নেই।
আপনার ছেলে ওই কোচিংয়ে পড়ে কিনা? এ প্রশ্নে তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে বলেন- হ্যা আমার ছেলেও ওখানে পড়ে। আমিতো কাজে থাকি তাই ওকে সময় দিতে পারিনা। কোচিংয়ে থাকলে কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকি। কোচিং তো অনেকেই করায় আচ্ছা আমি দেখবো, আমি বাইরে আছিতো বলে লাইনটি কেটে দেন।
এ বিষয়ে জানতে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ শফিউল আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেন নি।
এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় সহকারী পরিচালক শাহ্ মোঃ রাকিবুল হাসান বলেন- কোচিং ও গাইড বাণিজ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবুও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।