২রা অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছেন বিস্ময় ফুটবলার মিরাজ

ঝালকাঠি প্রতিনিধি ::: ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছেন বাফুফে এলিট একাডেমির বিস্ময় ফুটবলার মিরাজুল ইসলাম। ইউরোপের সেই ক্লাবে আপাতত ৩ মাসের প্রশিক্ষণ নেবেন তিনি। সেই সাথে বেশ কিছু ম্যাচ খেলবেন মিরাজ। সেখানে ভালো পারফর্ম করলেই মিলবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি।

দেশের ফুটবলে ফরোয়ার্ডদের আকালে গত ১০ বছরের সেরা প্রতিভা মিরাজুল ইসলাম। গতি, স্কিল ফিনিশিংয়ে বাংলাদেশ বয়সভিত্তিক জাতীয় ফুটবল দলের সেরা খেলোয়াড়। এমন উঁচুমানের ট্যালেন্ট পরবর্তী ধাপে পৌঁছাতে ইউরোপই হতে পারে উন্নতির আদর্শ মঞ্চ। সুযোগ পেলে মিরাজ হয়তো নিজের দেশ ও জাত চেনাবেন।

তরুণ ফুটবলারদের দেশের বাইরের চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য ইতিবাচক দিক। মিরাজুল ইসলাম মিরাজের বাড়ি ঝালকাঠি সদরের শেখের হাট গ্রামে। বাবা-মায়ের ৩ ছেলের মধ্যে সবার ছোট মিরাজ।

ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি টান ছিল তার। সেই টান থেকেই বিকেএসপিতে ভর্তি, ঢাকায় তৃতীয় বিভাগ ফুটবলে খেলা, বাফুফে একাডেমিতে টিকে যাওয়া, চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলা এবং সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগ ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানে নাম লেখানো।

মিরাজের বাবা খলিলুর রহমান দীর্ঘদিন ঝালকাঠি সদর থানা সংলগ্ন এলাকায় বাসাভাড়া করে স্ত্রী ও তিন ছেলে নিয়ে বসবাস করতেন। বাসার পাশে হোটেল
ব্যবসা করতেন। কিন্তু এখন নিজেদের ভিটেমাটিতে ঘর তুলে বাস করছেন শেখের হাট গ্রামে।

বেশ কয়েক বছর হলো অসুস্থ মিরাজের বাবা ঠিকমতো হাঁটতে-চলতে পারেন না। তার মা হেনারা বেগম মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত। মিরাজের বড় ভাই সুমন চাকরি করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে, মেঝো ভাই সুজন অটোভ্যান চালান।

দুই ভাইয়ের আয়ের সঙ্গে মিরাজের মায়ের গহনা যা ছিল বিক্রি করে বাড়িতে ঘর তুলেছেন। মেজো ভাই সুজনের অটো ভ্যান চালিয়ে যে রোজগার, তা দিয়েই চলে মিরাজদের সংসার। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন ঝালকাঠি পৌরসভা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে।

মোহামেডান তাকে দলে নেবে, সেটা যেন প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি। মিরাজ বলেন, ‘আমাকে একদিন পাপ্পু (রাশেদ পাপ্পু, একাডেমির কোচ) স্যার বলছিলেন-তোমাকে বিপিএলের একটা ক্লাব ডেকেছে। তবে ক্লাবের নাম বলেননি। আমি ভেবেছিলাম স্যার মজা করছেন। আরেকদিন স্যার বললেন-তুমি
তো আমাদের ছেড়ে মোহামেডানে চলে যাচ্ছো। তখন বিশ্বাস হলো এবং সাথে সাথে আমি বাড়িতে ফোন করে বাবা ও মাকে জানালাম। দুইজনই খুব খুশি হয়েছেন।’

মিরাজকে নিতে মোহামেডানকে গুনতে হয়েছে ১০ লাখ টাকা। বাফুফে এই ১০ লাখ টাকার ৪০ শতাংশ মিরাজকে দেবে। এমন এক সময় মিরাজের জীবনের মোড় ঘুরলো যখন তার টাকার খুব প্রয়োজন।

মিরাজ বলেন, ‘টাকার জন্য মায়ের অপারেশন করাতে পারছি না। এই চার লাখ টাকা আমি মায়ের অপারেশনের জন্য দেবো। আরো টাকা লাগবে।মোহামেডানে আসার আগেই অবশ্য মায়ের অপারেশনের কথা বলে বাফুফেতে আবেদন করেছিলাম সহযোগিতার জন্য।’

মিরাজ বিকেএসপির বরিশাল কেন্দ্রে ২০১৭ সালে ভর্তি হয়েছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ঝালকাঠিতে বিকেএসপির ট্রায়াল হয়েছিল। সে ট্রায়ালে টিকে গেলে মিরাজকে নিয়ে আসে সভার বিকেএসপিতে। সেখানে পুনরায় ট্রায়াল দিলে সেখানেও টিকে যান মিরাজ। তাকে নির্বাচন করা হয় বিকেএসপি বরিশাল কেন্দ্রের জন্য।

বিকেএসপি বরিশাল কেন্দ্রের কোচ আনোয়ার হোসেন মিরাজকে বলেন, ঢাকায় তৃতীয় বিভাগ লিগের একটি ক্লাবে খেলতে হবে। ২০২০ সালে করোনার মধ্যেই মিরাজ ঢাকার কিংস্টার ক্লাবে যোগ দেন। ওই ক্লাবে খেলা অবস্থায়ই একই বছর বাফুফের এলিট একাডেমির ট্রায়ালে অংশ নিয়ে টিকে যান তিনি।

২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবলে অংশ নেন মিরাজ। তিনি সুযোগ পান বরিশাল বিভাগীয় দলে। যে দলটি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফাইনালে চট্টগ্রাম বিভাগকে ২-১ গোলে হারিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে মিরাজ গলায় পরেছিলেন পদক।

বাফুফের একাডেমি থেকে প্রথম ফুটবলার হিসেবে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবে? কেমন অনভূতি আপনার? ‘অনেক ভালো
লাগছে। এখন যদি খেলার সুযোগ পাই তাহলে নিজে যতটুকু পারি তার শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করবো।’

প্রিমিয়ার লিগে সব দলেই বিদেশি আছে। তাদের সঙ্গে খেলতে ভয় লাগবে না? মিরাজের সাহসী উত্তর, ‘প্রশ্নই ওঠে না। আমি কখনও বিদেশি খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খেলিনি। তাতে সমস্যা নেই। ওরা আমার চেয়ে লম্বায় ও শক্তিতে হয়তো এগিয়ে থাকবে। কিন্তু আমাকে খেলতে হবে বুদ্ধি দিয়ে।ফুটবল যে বুদ্ধিরও খেলা।’

দেশে মিরাজের কোনো পছন্দের খেলোয়াড় নেই। তিনি মেসি, নেইমার ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ভক্ত। তিনজনের মধ্যে যদিও তিনি মেসিকেই সেরা মনে করেন এবং অনুসরণও করেন।

মিরাজের এখন একটাই লক্ষ্য, মোহামেডানের হয়ে খেলার সুযোগ পেলে গোল করা, ‘আমাকে যে উদ্দেশ্যে মোহামেডান নিয়েছিলো আমি চেষ্টা করেছি গোল করে তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে। মোহামেডানে ভালো খেলতে পেরে জাতীয় দলে অংশগ্রহণ শেষে এখন ইউরোপ গমনের সুযোগ এসেছে। সেখানেও আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে প্রিয় দেশ বাংলাদেশ এবং নিজ জন্মভূমি ঝালকাঠির জন্য গৌরব অর্জন করার।’

ঝালকাঠি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আল মামুন খান ধলু জানান, ‘মিরাজ ছোটবেলা থেকেই ফুটবলপ্রেমী। বাসা এবং স্টেডিয়ামের দূরত্ব

বেশি না হওয়ায় শিশু বয়সেই মাঠে এসে ফুটবল খেলতো। অনেকসময় অভিভাবক অতিষ্ঠ হয়ে ঘরের খুঁটির সাথে বেধে রাখতো। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে ফুটবল খেলা থেকে তাকে ফেরাতে পারেনি। সেই মিরাজ এখন মোহামেডান, জাতীয় দলে খেলে ইউরোপ গমনের সুযোগ পেয়েছে। আশাকরি সেখানেও মিরাজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারবে।’

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

সর্বশেষ