বোবা কান্না!
—শামীমা সুলতানা।
সীমান্ত’র সাথে বিয়ে হলেও সংসার করেছি নিলয় এর সাথে। চব্বিশ বছর হলো সীমান্তের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আজ ২৭ই এপ্রিল আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, এটাই বাঙ্গালী লক্ষ্মী নারীর মতো আমি গুছিয়ে একটা সংসার করছি। রোজ সকালে নিজহাতে নাস্তা তৈরি করি। দুপুরে খাবার রান্না করি। এগুলো আমি নিজ হাতেই করি। কারন নিলয়ের সাথে যখন আমার প্রেম হয়, তার কিছুদিন পর থেকেই আমরা দুজনে ছোট্ট সুখের একটি সংসারের স্বপ্ন দেখতাম। কত কথা হতো আমাদের! নবম শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরিক্ষা ছিল যেদিন। সেদিন একদিনেই দুই সাবজেক্ট পরিক্ষা সকল ১০টার পরিক্ষা শেষ হলো ১টায়। ফের ২-৩০মিঃ পরিক্ষা শুরু। দুপুরে খাবার খেতে গেলাম ভবোদার ছোট্ট হোটেলে। খুবই সাধারণ বাঙালি খাবার সেখানে। কিন্তু মায়াময় একটা পরিবেশ ছিল। ভবোদার কোনো সন্তান ছিলোনা টোনাটুনির সংসার বৌদি রান্না করে ভবোদা বাকিটা সামলায়। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা খেতে গেলে বৌদি নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে খাবার পরিবেশন করেন।
আমাদের কাছেও মনে হয় যেনো হোটেল নয় নিজের বাড়ি।নিলয় আমার সাথেই ছিল। আসলে ওই আমাকে খাবারের জন্য জোর করেছিল। খাবার অর্ডার করা হল। সাদা ভাত আর নদীর আইড় মাছ। আমার একার জন্য খাবার অর্ডার করলো কারন নিলয়দের দশম শ্রেণির পরিক্ষা এক বেলা ও বাড়িতে যেয়েই খাবে। নিলয়কে পাশে বসা ওকে রেখে একা খেতে কেমন লাগছিলো নিলয় সেটা বেশ বুঝতে পারছে। মৃদু হেসে বলল, ‘দূর বোকা আমিতো বাড়িতে যাচ্ছি’। কিন্তু তোমার যেতে সেই সন্ধ্যা হবে। অভুক্ত পেটে পরিক্ষা ভালো হবেনা। আমার কথা শুনে সে বলল, ‘কিন্তু মহারানী পরিক্ষা তোমার ভালো হওয়া চাই’! এর পরেও আমার আরষ্ঠতা ভাংছেনা দেখে নিলয় মুখ এগিয়ে বলল, ‘আমার মুখে একটা লোকমা দাও’। আমি ওকে খাইয়ে দিতেই বলল, ‘এবার শান্তিতো! দ্রুত খেয়ে নাও অনেকেই খেতে আসবে কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ’! আমি খাচ্ছি আর নিলয় বসে কথা বলছে। তবে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে কেউ দেখে যেনো সহজে বুঝতে না পারে। নিলয় আমার সাথে কত কৌশলই না অবলম্বন করতে হত! তখনকার সময় একটি তরুণ-তরুণী একত্রে কোথাও বসবে এমন ভাবা যায়না! প্রেম-ভালোবাসা যেন মস্ত পাপ ! কেউ দেখে ফেললেতো পরিবারের ইজ্জত শেষ। ভালোবাসার অপরাধে স্যারদের কি কঠিন বিচার ছিল। পিঠের ছাল তুলে দিতেন পিটিয়ে। খাবার টেবিলে চলছে আমাদের গল্প এক সময় নিলয় বললো, মিমা আমরা যখন বিয়ে করবো সংসার হবে আমাদের তুমি নিজ হাতে আমার জন্য রান্না করবে। তবে হ্যাঁ তোমার অবশ্যই সাহায্যকারী থাকবে। কিন্তু আমাকে সামলানোর দ্বায়িত্বটা সম্পূর্ণ তোমার। খাবার গুলো থাকবে তোমার হাতের তৈরি। নিলয়ের আবদার রাখতে তাইতো ২৩ বছর নিজ হাতেই রান্নাঘর সামলাচ্ছি। সীমান্তের সাথে মুসলিম ধর্মমতে রেজিষ্ট্রি করে সামাজিকভাবে বিয়ে দিয়েছেন বাবা- মা। আসলে ধর্মের দোহাই দিয়ে, সমাজ, সংস্কারের শিকলে মানুষ বাঁধার ক্ষমা রাখলেও মানুষের মন বাঁধার ক্ষমা রাখেনা! মন কারো অধীনস্থ নয়। সে চলে আপন মহিমায়। তাই তো আমার শরীর দিয়েছি সীমান্ত কে কিন্তু মন দিতে পারিনি! তাই সীমান্তের মাঝে আমি নিলয়ের ছায়া খুঁজে কাটাচ্ছি। আমাদের একমাত্র কন্যা তের বছরের সাফার আবদার বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিকীর দুই যুগ পূর্তি পালন করবে। সাফা তার নানা, নানি সহ অনেককে নিমন্ত্রণ করেছে। বাবা-মেয়ে হোটেলে খাবার অর্ডার করেছে। কেকের অর্ডার করেছে। সন্ধ্যা বেলা সবাই উপস্থিত। এবার সাফা বলল, ‘বাবা-মা একটা মজার খেলা খেলবে’। তার পারে কেক কাটা হবে। সাফা বলল, বাবা তুমি মায়ের দিকে তাকাবেনা আর মাও বাবার দিকে তাকাবে না। দুই যুগ তোমরা একত্রে। এবার বলবে কার শরীরের কোথায় অস্বাভাবিক কী কী চিহ্ন আছে। মানে তিল বা আচিল! আজ প্রমান হবে কে কাকে বেশি ভালোবাসে। প্রথমে মায়ের পালা। সাফার আয়োজনের ফাঁকে আমি কখন যে ফিরে গেছি চব্বিশ বছর পেছনে জানিনা! আমি সম্পূর্ণ নিলয়ের মাঝে ডুবে গেছি। আমার ভাবনাতে নিলয়। আমি বলছি, কপালের বাম পাশে কাটা দাগ, বুকের ঠিক মাঝ খানে বড় তিল……। আমার কথা শুনে সবাই অবাক! সীমান্ত কম্পিত কন্ঠে বলল, ‘মীমা মীমা চোখ খুলো কি বলছ তুমি? তুমি ঠিক আছ তো? তুমি কি বলছ এসব? আমি সম্বিৎ ফিরে পাই। চব্বিশ বছরের বোবা কান্না আজ আওয়াজ করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বলে, ‘আমায় ক্ষমা করো এই উত্তর আমার বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করলেই পেয়ে যাবে।