এস এন পলাশ ::: বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়নের দেশরত্ন শেখ হাসিনা মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন বাবুলের দুর্নীতি তদন্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বরিশালের এক সময়ের সুপরিচিত আজিজ কার্পেটের স্বত্বাধিকারী ছিলেন এই আনোয়ার হোসেন বাবুল। জীবনের দীর্ঘকাল ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে জড়িত থেকে হঠাৎ করেই ওই কলেজের অধ্যক্ষ পদে আশিন হন তিনি। ২০১৪ সালে ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ইসলাম হাওলাদার কলেজের দায়িত্ব তুলে দেন এই বাবুলের হাতে। এরপরই থেকেই অধ্যক্ষ হিসেবে চলতে থাকে বাবুলের রাম-রাজত্ব। হয়ে ওঠেন একজন পাকা দুর্নীতিবাজ। তবে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করন হলে ভাগ্য দেবীর দেখা পায় বাবুল। শুরু হয় জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ বানিজ্য।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২০ মে জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ১৬ টি বিষয়ে প্রভাষক পদে, ২ জন তৃতীয় শ্রেনীর ও ৪ জন চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীসহ মোট ২২ টি পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৭ অক্টোবর নগরীর সরকারি বরিশাল কলেজে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে উল্লেখিত বিভিন্ন পদে প্রথম স্থান অধিকারী ১৮ জনকে ওই কলেজে নিয়োগ প্রদান করা হয় এবং ৪ টি পদে শিক্ষক না পাওয়ায় পদগুলো শূন্য থাকে। পরবর্তীতে নিয়োগকৃতদের মধ্য থেকে ৩ জন শিক্ষক অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগদান করায় পদগুলো শূন্য থাকে। ফলে বৈধভাবে নিয়োগকৃতদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ জন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০২০ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হলে সুচতুর সাবেক অধ্যক্ষ বাবুল সমকাল পত্রিকার ওই মূল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সরিয়ে পত্রিকার লোগো ফটোকপি করে তার সাথে নকল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয় বাড়িয়ে ব্যাকডেট দেখিয়ে একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে ভুগোল বিষয়ের শিক্ষক সুজন দে, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক নুসরাত রুবাইয়া, যুক্তিবিদ্যা বিষয়ের শিক্ষক শিখা সাহা, এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপনন বিষয়ের শিক্ষক সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন যারা কখনোই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেনি। এমন বিষয়টি নিশ্চিত করেন বরিশাল কালেক্টটর স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর খন্দকার অলিউল ইসলাম। তিনি তৎকালিন সময়ে ওই নিয়োগ পরীক্ষার প্রধান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলেন।
তিনি বলেন, বাবুল এতো বড়ো টাউট আগে জানলে ওর প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা আমি নিতাম না। তবে আমরা যাদের নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছি পরবর্তীতে তাদেরই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কতজন নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছি বিষয়টি খেয়াল নেই তবে সম্ভবত ২০-২২ জনের মতো হবে। পরবর্তীতে শুনেছি নিয়োগকৃত কয়েকজনকে কলেজ থেকে বাদ দিয়ে আমার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি ঘষামাজা করে বিষয় বাড়িয়ে অর্থের বিনিময়ে অনেককেই নিয়োগ দিয়েছে।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগে জাকির হোসেন নামে দুদকের একজন কর্মকর্তা বাবুলের দুর্নীতি বিষয়ে জানতে আমাকে ডেকেছিলেন। আমি দুদক অফিসে গিয়ে বাবুলের নানা অপকর্ম তুলে ধরেছি।
তিনি আরো বলেন, বাবুল আমার ছোট, আমরা একই কলেজে পড়াশুনা করেছি। তাকে প্রায়ই বিএম কলেজের ক্যাম্পাসে দেখতাম তবে সে পাস করেছে কিনা আমার জানা নেই।
জানা গেছে, বাবুল অধ্যক্ষ থাকাকালিন সময়ে নিয়োগকৃত ৮ জন শিক্ষক ও কর্মচারীকে বাদ দিয়ে মোটা অংকের বিনিময়ে একাধিক পদে প্রায় ২০ জনকে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এমনকি কলেজের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই নিয়োগ প্রাপ্ত অফিস সহকারি শহিদুল ইসলাম আলামিনকে বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে তার স্থলে নিজাম উদ্দিনকে অফিস সহকারি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। পরে এমন দুর্নীতির বিষয়টি উল্লেখ করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সচিব বরাবর গত ১৩ মার্চ ২০২২ সালে একটি লিখিত অভিযোগ দেন আলামিন।
অভিযোগে তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ, তথ্য গোপন, পত্রিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জাল করে বিষয় বাড়ানো, নিজ স্বজনদের চাকরি দেয়াসহ বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের বিষয় উল্লেখ করেন। অভিযোগের বিষয় তদন্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় তিনি ওই কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন বাবুলকে অভিযোগের বিষয়ে জানিয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়োগের বৈধ কাগজপত্র জমা দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। একের পর এক নানা টালবাহানা সাজিয়ে সাবেক অধ্যক্ষ বাবুল বিষয়টি এড়িয়ে যান। পরে প্রফেসর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন ওই বছরের ১২ জুন সরেজমিনে কলেজে উপস্থিত হয়ে আনীত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করেন। তখন কলেজের অধ্যক্ষ বাবুল অভিযোগের বিরুদ্ধে কোন বৈধ কাগজ-পত্র দেখাতে পারেনি।
তদন্তের স্বার্থে কয়েকদিনের সময় উল্লেখ করে পরবর্তীতে বৈধ কাগজ-পত্র দেখাতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তারপরও সাড়া না মেলায় তদন্তে বাবুলের অসহযোগিতার কথা এবং নিয়োগের বৈধ কাগজ-পত্র দেখাতে ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রনালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেন।
এ বিষয়ে প্রফেসর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দেশরত্ন শেখ হাসিনা মহাবিদ্যালয় নামের কলেজে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল। তদন্তকালিন সময়ে আমি সরেজমিনে ওই কলেজে গিয়েছি এবং প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র দেখতে চাইলে অধ্যক্ষ বাবুল দেখাতে ব্যর্থ হন। এরপর পরপর তাকে ৩ বার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তিনি দেব, দিচ্ছি বলে টালবাহানা শুরু করেন। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার বৈধ কাগজ-পত্রসহ নানা বিষয়ের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আমার কাছে জমা দিতে ব্যর্থ হলে জালিয়াতির বিষয়টি প্রতীয়মান হলে প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করে মন্ত্রনালয়ে জমা দেই। এরপরই নড়ে বসে মন্ত্রনালয়। তারা বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে দায়িত্ব দেয়। বর্তমানে অভিযোগের বিষয়টি বরিশাল দুদকের উপ সহকারি পরিচালক জাকির হোসেনের তদন্তে রয়েছে। তিনি বিগত তিন মাস ধরে বিষয়টি তদন্ত করছেন।
এ বিষয়ে গত সোমবার (১৩ মে) জাকির হোসেন বলেন, রবিবার ১২ মে আমার বদলির অর্ডার হয়েছে। আমি কয়েকদিনে মধ্যেই নতুন কর্মস্থলে যোগদান করবো। আজ বরিশাল অফিসে আমার শেষ কর্মদিবস। তাছাড়া তদন্তকালীন সময়ে এই বিষয়ে কমিশনের নির্দেশ ছাড়া কোন কিছু বলার বৈধ কর্তৃপক্ষ আমি নই। এ বিষয়ে কমিশনের মুখপাত্র কেবল বলতে পারবে। তবে দুদকের তদন্তের বিষয় জানতে চাইলে সাবেক অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন বাবুল অকপটে স্বীকার করে বলেন, তদন্ত চলছে। কমিশন যেসব বিষয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছে আমি তাদের সব বলেছি। অপরাধ তো অপরাধ, আমি অপরাধ করলে তা চাপা থকবে না। তাছাড়া কলেজ জাতীয়করনের আগেই আমি অধ্যক্ষের দায়িত্ব ছেড়ে এসেছি।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে যে ২২ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল তাদেরই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমি তাদের কাউকে বাদ দেয়নি। যদিও পরবর্তীতে কয়েকজন কলেজ ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে। তাদের পরিবর্তে নিয়োগ পরীক্ষায় যারা দ্বিতীয় হয়েছিল তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এটা কলেজের রেজুলেশনে আছে।
অফিস সহকারি শহিদুল ইসলাম আলামিনকে কেন বাদ দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলামিন তো নিয়োগপ্রাপ্ত নয়। আলামিনের স্থলাভিষিক্ত অফিস সহকারি নিজাম উদ্দিন কি নিয়োগপ্রাপ্ত এমন প্রশ্নের কোন সদ্ত্তুর না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমি অনেক কষ্ট করে কলেজটি দাড় করিয়েছি। আমার নিজের জমি দিয়েছি। আর এখন আমার অপবাদের শেষ নেই।
২০২২ সালে তদন্তে প্রফেসর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেনকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার বৈধ কাগজ-পত্রসহ নানা বিষয়ের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখাতে পারেননি কেন জানতে চাইলে বলেন, তখন আমি কলেজের দায়িত্বে ছিলাম না। তখন যারা কলেজের দায়িত্বে ছিল সেটা তাদের ব্যাপার।
অপর এক প্রশ্নে বরিশাল কালেক্টটর স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর খন্দকার অলিউল ইসলাম আপনার জালিয়াতির বিষয় নিয়ে যেসব কথা বলেছেন তা জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, স্যার কেন বলেছে আমি বলতে পারবো না।