প্রিন্স তালুকদার : সবজির ভর মৌসুম চলছে। শীতের সবজি বরিশালের বাজারে এসে গেছে। উৎপাদন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। কিন্তু এসব সবজি কৃষকের মাঠ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে সড়কে চাঁদাবাজিসহ চার থেকে পাঁচবার হাত বদল হচ্ছে। এতে বরিশালের বাজারে ভোক্তাকে এখনো চড়া দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ভোক্তা চড়া দামে কিনলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষক নায্যমূল্য পাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ও ভোগের সঙ্গে জড়িত দুই পক্ষই ঠকছেন। মাঝপথে বাজার ব্যবস্থাপনা কূটকৌশলের মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তার পকেটে থাবা দিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে মাঠে কৃষক ও বাজারে ভোক্তাদের ঠকতে হচ্ছে। দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। পাশাপাশি সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সবজির দামসংক্রান্ত শেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেও দেখা গেছে এমন চিত্র। বছরের পর বছর এমন চিত্র দেখা গেলেও নিয়ন্ত্রনকারী সংশ্লিষ্টরা একরকম নির্বিকার। অনুসন্ধানে জানা যায়, বরিশালে সবজি উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হচ্ছে। এর মধ্যে আছে-স্থানীয় ব্যবসায়ী, মজুতদার, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী, প্রক্রিয়াজাতকারী, কেন্দ্রীয় বাজার বা টার্মিনাল, খুচরা বাজার, খুচরা ব্যবসায়ী ইত্যাদি। প্রতিটি ধাপেই সবজির মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আছে নামে-বেনামে চাঁদাবাজি। বরিশালের মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সবজি বোঝাই ট্রাকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি বরিশাল বহুমুখী পাইকারি কাচা বাজার আড়তে সরাসরি পণ্য বিক্রিতে কমিশন বাণিজ্যে পণ্য খালাস করতে হচ্ছে। এছাড়া চলমান হরতাল ও অবরোধে ট্রাক ভাড়া নতুন করে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়েছে। ফলে এসব কিছু যোগ করে সবজির দাম নির্ধারণ হচ্ছে। এর সঙ্গে লাভ যোগ করে খুচরা বিক্রেতা ভোক্তার হাতে পণ্য তুলে দিচ্ছেন। এতে বেশি টাকায় ক্রেতাকে পণ্য কিনতে হচ্ছে। কৃষি বিপপন অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি কেজি বেগুনের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ২৬ পয়সা। একজন ব্যবসায়ী যশোরে পাইকারি বাজার থেকে প্রতি কেজি বেগুন ২৫-২৮ টাকায় কিনে বরিশাল বহুমুখী পাইকারি কাচা বাজার আড়তে ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করেন। পরে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি। একইভাবে প্রতি পিস বড় আকারের লাউয়ের উৎপাদন খরচ ১৩ টাকা ২০ পয়সা। গ্রামের পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি শিমের উৎপাদন খরচ ৬ টাকা ৮৮ পয়সা। গ্রামের পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৩৬ টাকা। সেই শিম গ্রাম থেকে এনে বরিশাল বহুমুখী পাইকারি কাচা বাজার আড়তে বিক্রি করা হচ্ছে ৫০-৫৮ টাকায়। আর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬০-৭০ টাকা। প্রতিকেজি মুলার উৎপাদন খরচ সাড়ে ৫ টাকা। গ্রামের পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২-২৪ টাকায়। সেই মুলা বরিশাল বহুমুখী পাইকারি কাচা বাজার আড়তে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা। আরও জানা গেছে, প্রতি কেজি ঢেঁড়সের উৎপাদন খরচ ১২ টাকা ৪০ পয়সা। একজন ব্যবসায়ী যশোরে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ঢেঁড়স ৩০-৩২ টাকায় বিক্রি করছেন। বরিশাল বহুমুখী পাইকারি কাচা বাজার আড়তে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা। জানতে চাইলে বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য আরিফুর রহমান বলেন, মাঠে কৃষক আর বাজারে ভোক্তা ঠকেই যাচ্ছেন। এর প্রতিকার মিলছে না। ধারাবাহিকভাবে সব সময় এ ধরনের আচরণ চলতে পারে না। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা লুটছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজার কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি রাস্তায় নামে বেনামে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যদি কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রির উপায় বের করা যায় তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা করতে পারবে না। সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি কেজি পটল উৎপাদনে চাষির খরচ সাড়ে সাত টাকা। গ্রামের পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ১৪-১৫ টাকায়। বরিশাল বহুমুখী পাইকারি কাচা বাজার আড়তে দাম মানভেদে ৩৫-৪০ টাকা। আর খুচরা বাজারে সেই পটল কিনতে একজন ভোক্তাকে গুনতে হয় ৭০-৮০ টাকা। অর্থাৎ সাড়ে ৭ টাকার পটলে কৃষক পাচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। জানা গেছে, নিয়ন্ত্রণকারী সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা বিভিন্ন পর্যায়ে সবজির দাম বৃদ্ধির পেছনে পরিবহণ চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলো প্রতিকার করতে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছেন। কিন্তু তার সুফল স্থায়ী হয়নি। ব্যবস্থা নেওয়ার পর সাময়িকভাবে বরিশালের বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়লেও কিছু দিনের মধ্যে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে যায়। বছরের পর বছর এমন চিত্র দেখা ঊর্ধ্বতন মহল শুধু আদেশ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। কিন্তু এই আদেশ কার্যকরে সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল জানান, বাজারে সবজির কোনো সংকট নেই। কিছু সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। তবে কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত দামের ব্যবধান খতিয়ে দেখা হবে। অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনা হবে। যশোরের সবজির সবচেয়ে বড় মোকাম বাড়িনগর সাধারণ হাট কাঁচাবাজার। সেখানে সবজি বিক্রি করেন মো. রাজু মিয়া। তিনি জানান, ৪ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বেগুন চাষ করেছি। সেগুলো ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। অবরোধের কারণে তারা বরিশাল, ঢাকায় নিতে পারছে না বলে কম দাম বলছে। বাড়িতে ফেরত নিতে পারছি না। পচে যাবে। ফলে কম দামেই বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু বরিশাল, ঢাকায় শুনছি অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। যশোর থেকে সবজি কিনে বরিশাল বহুমুখী পাইকারি কাচা বাজার আড়তে বিক্রি করেন ব্যবসায়ী মো. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে ৩ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকা। কিছু দিন আগেও ১২-১৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আর চলমান হরতাল অবরোধের কারণে এখন ২০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ টনের ট্রাক ভাড়া ১৩-১৪ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। যা কিছু দিন আগেও ১৬-১৮ হাজার টাকা ছিল। আর জ্বালানি তেলে দাম বৃদ্ধির আগে ১২-১৩ হাজার টাকা ছিল। সাথে ২-৩ জন থাকি। তাদের থাকা খাওয়ার খরচ। সব মিলে কেনা দামের চেয়ে তিনগুণ বেড়ে যায়। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, উৎপাদন খরচের চেয়ে বরিশালে ৬ থেকে ১২ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। অনেকে বলেছেন, সবজি পচনশীল পণ্য। দ্রুত পচে যায়। এ কারণে অপচয়জনিত খরচও দামের সঙ্গে যুক্ত হয়। এছাড়া সবজি বোঝাই ট্রাক বা পিকআপ দুর্ঘটনা, নানা কারণে আটকে থাকায়ও খরচ বাড়ে। রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ খড়খড়িতে এ সবচেয়ে বড় সবজির মোকাম। প্রতিদিন কয়েক হাজার কৃষক এ মোকামে সবজি বিক্রি করতে আসেন। মোকামের আড়তদার আব্দুর রহিম জানান, রাজশাহীর খড়খড়ি, মোহনপুর, দুর্গাপুর এবং বিভিন্ন উপজেলার সবজির আড়ত থেকে প্রতিদিন ২০০ ট্রাকে বরিশাল, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু অবরোধ চলার কারণে ট্রাক মালিকরা ঝুঁকি নিচ্ছেন না। মাত্র ৩০ থেকে ৪০টি ট্রাক রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে আড়তে প্রচুর পরিমাণে সবজির আমদানি হলেও সেগুলো বিক্রি হচ্ছে না। তাছাড়া শীতের সবজি বাজারে ব্যাপকভাবে নামতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে সবজির দামে নেমেছে ধস।
