৩০শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

বরিশালে করোনা উপসর্গে মৃত্যু বাড়ছে, হিসাব দিচ্ছে না স্বাস্থ্য বিভাগ!

বরিশাল বিভাগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর পাশাপাশি বাড়ছে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিদিন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত লোকজনের মৃত্যুর হিসাব দিলেও উপসর্গে মারা যাওয়া লোকজনের হিসাব দেয় না। এর ফলে উপসর্গে মারা যাওয়া লোকজনের হিসাব আলোচনায় আসছে না।

করোনাভাইরাসের উপসর্গ জ্বর-শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যাওয়া লোকজনের অধিকাংশই বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডের রোগী।

বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগের সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ মার্চ থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত তিন মাসে কেবল বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বাকি ৬৯ জন মারা গেছেন উপসর্গে।

এ ছাড়া ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর—এই চার জেলার হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে ২৭ জনের মৃত্যুর সরকারি তথ্য পাওয়া গেছে। তবে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজসহ বিভাগের অন্য হাসপাতালের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে মারা যাওয়া মোট রোগীর সংখ্যা ১৩৩ জন। এর বাইরেও বাড়িতেও অনেক রোগীর মৃত্যু হয়েছে উপসর্গে। এ পর্যন্ত বাড়িতে ২৫ জনের মৃত্যুর নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) সকাল পর্যন্ত এ বিভাগে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৫ জন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরিশাল জেলায়। এই জেলায় মারা গেছেন ২৪ জন। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পটুয়াখালীতে মারা গেছেন ২১ জন। এ ছাড়া ঝালকাঠিতে ৮, পিরোজপুরে ৫, ভোলায় ৪ ও বরগুনায় ৪ জন মারা গেছেন।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র বলছে, ১৭ মার্চ থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত এই হাসপাতালের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে ৬৮৫ জন রোগী ভর্তি হন। এর মধ্যে ২৬৯ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। হাসপাতালের করোনাভাইরাসে ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ১০৬ জন মারা গেছেন, যাঁদের মধ্যে মাত্র ৩৭ জন পজিটিভ ছিলেন।

এই হাসপাতালে বিপুলসংখ্যক রোগীর মৃত্যুর পেছনে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা না পাওয়া ও চিকিৎসকদের অবহেলাকে দায়ী করেছেন রোগীদের স্বজনেরা।

মারা যাওয়া একাধিক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, করোনাভাইরাস ইউনিটে নামমাত্র চিকিৎসা হয়। চিকিৎসকেরা রোগীর কাছে যান না। কোনো রোগীর অবস্থা খারাপ হলেও চিকিৎসক ডেকে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে শ্বাসকষ্টের রোগীদের ফেলে রাখা হয় অক্সিজেন এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা ছাড়া।

চিকিৎসায় অবহেলা-অনিয়মের অভিযোগ
বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্মাণাধীন নতুন ভবনে করোনাভাইরাস ওয়ার্ড চালু করা হয়। ওয়ার্ডটিতে দুজন সহকারী অধ্যাপকের নেতৃত্বে ৯ জন চিকিৎসক দায়িত্বে রয়েছেন।

করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেওয়া এক রোগী (৩৫) অভিযোগ করে বলেন, ‘দিনে ২-৩ বার নার্স আসেন ইনজেকশন দিতে। এ ছাড়া তাঁদের পাওয়া যায় না। চিকিৎসকের দেখা পাইনি কখনো। তাঁরা সব সময় তাঁদের নির্ধারিত কক্ষে থাকেন।’

ওই রোগী বলেন, ‘আমি চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় প্রায় প্রতিদিনই করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে দু-একজনকে মারা যেতে দেখেছি। মারা যাওয়া সেসব রোগীর লাশ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকতে দেখেছি।’

উদাহরণ দিয়ে ওই রোগী বলেন, গত ২৪ জুন বেলা সাড়ে ৩টায় মনোয়ারা বেগম নামের এক নারী মারা যান। তাঁর স্বজনেরা অসহায়ের মতো ছোটাছুটি করছিলেন। কিন্তু লাশ সরানোর জন্য হাসপাতালের কারও কোনো উদ্যোগ ছিল না। এভাবে চার ঘণ্টা লাশটি ওয়ার্ডই পড়ে থাকার পর হাসপাতালের লোকজন এসে সেটি বাইরে বের করেন।

ওই দিন রাত ১২টায় ইদ্রিস হাওলাদার নামের এক রোগীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো নার্স-চিকিৎসক তাঁর কাছে আসেননি। ভোর পাঁচটার একটু পরে তিনি মারা যান। ওই ব্যক্তির লাশ ওয়ার্ড থেকে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সরানো হয়। একইভাবে জরুরি সেবা দরকার এমন রোগীদের অক্সিজেন পেতে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় দায়িত্বরত লোকজনকে।

অভিযোগ অস্বীকার করে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বাকির হোসেন বলেন, ‘আমার কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নেতৃত্বে ৯ জন চিকিৎসক দায়িত্বে আছেন। তাঁরা রোস্টার অনুযায়ী যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন। তবে নার্সদের সঙ্গে তাঁদের সমন্বয়ের অভাব আছে, এটা ঠিক। এসব সমস্যা যাতে না থাকে, সে জন্য করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) দেওয়ার চেষ্টা করছি। এটা হলে এই সমস্যা থাকবে না।’

এত রোগীর মৃত্যুর বিষয়ে পরিচালক বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আগে হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ১৬ জনের মৃত্যু হতো। এখন গড়ে ১৪ জনের মৃত্যু হচ্ছে। সেদিক বিবেচনায় অধিক হারে মৃত্যু হচ্ছে, এটা বলা যাবে না। তবে করোনাভাইরাস ইউনিটে যাঁরা ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ রয়েছে এমন রোগীদের অনেকে হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, কিডনি, লিভারজনিত নানা রোগে ভুগছেন।

বাকির হোসেন আরও বলেন, ‘বিভাগের সব জেলার গুরুতর রোগীদের শেষ মুহূর্তে এই হাসপাতালে পাঠানো হয়। দেখা যায়, যেসব রোগী এখানে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই ফুসফুস শক্ত হয়ে যায়। এতে অক্সিজেন দেওয়া হলেও এসব রোগীর ফুসফুস আর সক্রিয় হয় না। ফলে এসব রোগী মারা যান। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে মৃত্যুর হারের চেয়ে এখনো আমাদের হাসপাতালে মৃত্যুর হার কম।’

-প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

সর্বশেষ