৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

“বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ভাবনার উন্নয়ন জরুরি”

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “শিশুবয়সে নির্জীব শিক্ষার মতো ভয়ংকর ভার আর কিছুই নাই; তাহা মনকে যতটা দেয় তাহার চেয়ে পিষিয়া বাহির করে বেশি।” কবিগুরু এখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ শিশুদের জন্য শিক্ষার পরিবেশ হবে নান্দনিক। যেখানে একজন শিশুর সকল অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। উপযুক্ত পরিবেশে একজন শিশু শিক্ষাকে সহজেই আপন করে নিতে পারবে। নয়তো শিক্ষা হবে শিশুর জন্য নিপীড়নের নামান্তর। তাছাড়া মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে তার মূল ভিত্তি। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি যত মজবুত হবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান তত বৃদ্ধি পাবে। কথায় আছে, “যে মূলোটা বাড়ে তা পত্তনেই বুঝা যায়।” অর্থাৎ কোনো কাজ যদি সুন্দরভাবে শুরু করা যায় তাহলে সেই কাজ সঠিকভাবে সমাপ্ত হবে এটাইস্বাভাবিক। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যুগ যুগ ধরে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সর্বমহলের আন্তরিকতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন।কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো থাবায় বাঙালি জাতি যেমন মুখ থুবড়ে পড়েছিল, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিও বিমাতাসুলভ আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। সেই ইতিহাস না টেনে বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়নের পরেও প্রাথমিক শিক্ষা কতটা বৈষম্যের স্বীকার তা উল্লেখ করাই সমীচীন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশেও ৬৫,৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা বলতে সাধারণত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থাকেই বুঝায়। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই সেখানে অ্যাকাডেমিক ভবন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীর পাশাপাশি বিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শিক্ষা কারিকুলামসহ সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকবে। যার অনেককিছুই বিদ্যমান রয়েছে। তবে শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীই মূখ্য বিষয় নয়। প্রতিষ্ঠালনগ্ন থেকেই একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর ২০১২ সালে ‘দপ্তরি কাম প্রহরী’ নিয়োগ বিধিমালা প্রণীত হয় এবং ২০১৩ সালে নিয়োগ প্রদান শুরু হয়। সেখানেও বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। পুরাতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হলেও নব জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনও পর্যন্ত ‘দপ্তরি কাম প্রহরী’ নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আবার মৃত্যু, স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ, আদালতের রায়ে চাকরিচ্যুতি বা অন্যকোনো কারণে ‘দপ্তরি কাম প্রহরী’র যে পদগুলো শূন্য হচ্ছে সেই পদে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। কোনো কর্মচারী না থাকায় প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতাসহ নানাবিধ কাজ করতে হচ্ছে; যা দৃষ্টিকট্ ুশুধু তাই নয়, কর্মচারী না থাকায় শিখন-শেখানো কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। বর্তমানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৬টি শ্রেণিতে পাঠদান করা হয়। অথচ সেখানে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দিতেও রাষ্ট্রের কার্পণ্য ও উদাসীন ভাব চোখে পড়ার মতো। পক্ষান্তরে একটি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়; যেখানে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি অর্থাৎ মাত্র তিনটি শ্রেণিতে পাঠদান করা হয়। সেখানে অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আয়া ও অফিস সহায়ক এই ৫টি পদে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়।একটি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবংক্ষেত্রবিশেষে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চেয়েও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজের পরিধি বিস্তৃত। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় পর্যন্ত প্রায়শই অনেক তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকগণ শিখন-শেখানো কার্যক্রম স্থগিত রেখে তথ্য প্রেরণে বাধ্য হন। তাই ‘দপ্তরি কাম প্রহরী’র পাশাপাশি একজন অফিস সহকারী কাম কাম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ প্রদান করা অতীব জরুরি। এরকম অনেকগুলো অসঙ্গতি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে। শুধু কর্মচারী নয় বরং শিক্ষক সংকটও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য এক বিরাট অন্তরায়। এক শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়ে একসাথে ৬টি শ্রেণির পাঠদান শুরু হয়। অধিকাংশ এক শিফটের বিদ্যালয়ে ৬ থেকে ৭ জন শিক্ষক কর্মরত। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষককে সকাল ৯:৩০টা থেকে দুপুর ১:০০টা পর্যন্ত একটানা শিখন-শেখানো কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয়, যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। যদিও এক শিফটে পরিচালিত হলে তা শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গলজনক। নীতিনির্ধারকদের পরামর্শও তাই। তবে শিক্ষক সংখ্যা না বাড়িয়ে এক শিফটে পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ শিক্ষকগণ বিভিন্ন ছুটি ও দাপ্তরিক কাজে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকলে শিক্ষক সংকটের কারণে বিদ্যালয়ের শিখন-শেখানো কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়। উপর্যুপরি প্রতিটি ক্লাস্টারের একটি বিদ্যালয়ে ৪+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য নতুন শ্রেণি প্রাকÑপ্রাথমিক চালু হয়েছে। ৫+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি আগে থেকেই চলমান রয়েছে। অচিরেই সকল বিদ্যালয়ে ৪+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাকÑপ্রাথমিক শ্রেণি চালুর সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে নতুন শিক্ষক নিয়োগের পূর্বে আরও একটি শ্রেণি চালু করলে শিক্ষকদের উপর চাপ বাড়বে। সেক্ষেত্রেও পাঠদান কার্যক্রম বিঘিœতহওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রতিটি নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে গবেষণা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ভাবনার উন্নয়ন ঘটানো আরও জরুরি। নীতিনির্ধারকগণ প্রাথমিক শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যেন ভাবনার উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি। অনেকক্ষেত্রে এমনটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবার অনেকসময় দায়িত্বশীলদের মুখেও শোনা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় এত বরাদ্দ কেন? এটা মূর্খের প্রলাপ বৈ আর কিছু নয়। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লক্ষ শিক্ষক কর্মরত আছেন। এছাড়াও উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা এবং বিদ্যালয় ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ ও নতুন ভবন নির্মাণসহ সকল ব্যয় এই বরাদ্দের অন্তর্ভুক্ত। এমন কোনো মন্ত্রণালয় নেই যেখানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো এত জনবল ও অবকাঠামো রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রায় ২ কোটি শিক্ষার্থী এই মন্ত্রণালয়ের সাথে যুক্ত। যাদের জন্য পাঠ্যবই, উপবৃত্তি,স্কুল ফিডিংসহ নানাবিধ খাতে অর্থ ব্যয় করতে হয়। এই বিশাল পরিবারের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ হয়েছে ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের জনবল, অবকাঠামো ও পারিপাশ্বিক বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যাবে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চেয়ে অপ্রতুল। তবুও অর্ধশিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত অনেকেই এই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকে বেশি মনে করেন। এমন মনে করার কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে অনেককিছুতে উন্নয়ন ঘটেছে বটে; তবে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ভাবনার উন্নয়ন এখনও ঘটেনি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন করতে হলে সর্বাগ্রে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নকরতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবেশ উন্নযন ও শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষকম-লীসহ সকলের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে হবে। অন্যান্য দপ্তরের তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষায় যুগ যুগ ধরে যে বৈষম্য বিদ্যমান তা নিরসন করতে হবে। তাছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা একটি জাতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে একদিন নতজানু হতে হবে। উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সবদিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে বলেই তাঁরা এতটা অগ্রবর্তী। অথচ আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে যেন কেউ ভাবছে না। তাই বলতে হচ্ছেÑ ‘বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ভাবনার উন্নয়ন জরুরি।’

লেখক:
মো. রিয়াজ আহসান
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
রাজাপুর, ঝালকাঠি।

সর্বশেষ