৩০শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

সাহারা খাতুন একাকীত্বের জীবন বেছে নিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেন আওয়ামীলীগে !

সোহেল সানি :

সাহারা খাতুন, অবশেষে চলে গেলেন মৃত্যুপুরীর দেশে। তাঁর চিরস্থায়ী ঠিকানায়।
কদিন আগে তাঁর মৃত্যুর গুজবের প্রতিবাদ করে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেইসবুকে। উৎসুক গুজব রটনাকারীদের রাশ টেনে ধরার উপায় না থাকলেও নিন্দা করেছিলাম তীর্যক ভাষায়। জীবিত মানুষকে মৃত ঘোষণা করা কোন মানুষের কাজ নয়, গর্হিত অপরাধ, মহাপাপ -ইত্যাদি বলে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম।
কিন্তু আজ সেই ভাষা উধাও হয়ে গেলো – মনটা বিষাদ বেদনায় ভরে গেলো। চোখে কান্নার সাঁতার কাটতে শুরু হল, সত্য একটি খবর মুঠোফোনে জানালেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন- বিএমএ এর সভাপতি ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। সে খবর অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের মৃত্যুর খবর। আজ আর গুজব নয়, সাহারা খাতুন সত্যিই চলে গেছেন মৃত্যুপুরীর দেশে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। ভারাক্রান্ত কন্ঠে শোনালেন, ‘সাহারা আপা আর নেই।’ মূহুর্তে থমকে গেলাম- অন্তর আত্মা কন্ঠে ধারণ করলো “ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”। আওয়ামী প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহারা খাতুন ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি ও সাবেক এমপি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ও রাজপথের সাহসী সহযোদ্ধা। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ জালালও ১৬ দিন ধরে করোনাক্রান্ত অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে আজই ল্যাবএইড হতে বাসায় ফিরেছেন। আজ মনটা বেশ তরতাজা ছিলো। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের এক সময়ের কিং মেকার বর্ষীয়ান জননেতা আমির হোসেন আমু ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক হওয়ার কারণে। ফোনে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে সাহারা খাতুনের কথাও বললাম। তিনি বললেন, ‘দোয়া করি আল্লাহ তাকে সুস্থ করুন।’
আওয়ামী লীগে মূলত “আমু-নাসিম-পল্টু-সাহারা” শেখ হাসিনার দুর্দিনের দুর্দমনীয় একটা বিশ্বস্ত গ্রুপ বলেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। এরপর পরই বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল ভাইকে আমি নিজ থেকেই ফোন দিলাম। তিনি বললেন, ‘আমু ভাই তো মুখপাত্র ও সমন্বয়ক হয়ে গেলেন, তিনি ভাল করবেন।”
তারপর বললাম, লিডার সামনে ভাল খবর আছে – কি খবরও তাও বললাম। তারপর আরও কিছু কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
কিন্তু সেই ফুরফুরে মনটা নিমিষেই বিষাদ বেদনায় ডুবে গেলো, সাহারা খাতুনের মৃত্যুর খবরে। সবাই আন্দাজ করছিলেন, সাহারা খাতুন হয়ত এমন জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাবেন না। কিন্তু তারপরও বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা – তাইতো থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া। বর্ষীয়ান নেত্রী সাবেক মন্ত্রী সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে সবাই শোকাভিভূত।
বর্ষীয়ান নেতা মোজাফফর হোসেন পল্টুর মাধ্যমেই সাহারা খাতুনের সঙ্গে পরিচয়। মোজাফফর হোসেন পল্টু যখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তখন সাহারা খাতুন সহসভাপতি। আমি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক এবং পরবর্তীতে যখন ছাত্রলীগের ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা তখন সাহারা খাতুনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন, একটা কাজে গেলে তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করে দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি আমার কাছে সাংবাদিক নও – তা যত বড় সাংবাদিকই হও, তুমি আমার দলের ভাই, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক।”
আমি ছিলাম তাঁর স্নেহার্থী। শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁর নিষ্পাপ মুখাবয়ব আমার চোখের আয়নার ভেসে উঠছে- প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠছে তাঁর সুমহান কীর্তিগুলো। রাজপথে পেটোয়া বাহিনীর হাতে ফার্মগেটে তাঁর নির্যাতিত হওয়ার নির্মম দৃশ্য আমি কী করে ভুলি?
মোবাইলটা হাতে নিয়ে মোজাফফর হোসেন পল্টুকে কল করলাম। মূহুর্তে রিসিভ করেই বাকরুদ্ধ কন্ঠে বললেন, “আমার নাসিম সাহেবও চলে গেল, সাহারা খাতুনও চলে গেল। সোহেল সানি সাহারা খাতুনের খবর দিবিতো? শুনেছি, মনটা ভেঙ্গে গেল-রে। একে একে সব সহকর্মীকেই যে হারাচ্ছি। ভালো থাকিস সাবধানে থাকিস বলে রাখলেন ফোনটা।
ঠিকই বলেছেন মোজাফফর হোসেন পল্টু, তাঁদের সম্পর্কটা তো ঘনিষ্ঠ হবেই। এক সাথে রাজনীতির দীর্ঘপথ হেঁটেছেন। স্বাধীনতাত্তোর ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা আর সাধারণ সম্পাদক যখন মোজাফফর হোসেন পল্টু। তখন থেকেই সাহারা খাতুনের নগর রাজনীতিতে সরব পদচারণা। ‘৮৭ সাল থেকে ৯২ সাল পর্যন্ত মোজাফফর হোসেন পল্টু ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি – সেই কমিটির এক নম্বর সহসভাপতি সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম এবং অন্যতম সহসভাপতি সাহারা খাতুন। ‘৯২ সালে মোজাফফর হোসেন পল্টু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনও কেন্দ্রীয় রাজনীতি অবতীর্ণ হন। তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে সহ আইন সম্পাদক হিসাবে উঠে আসেন। ‘৯১ সালে নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় ‘৯৬-এ মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হওয়া সাহারা খাতুন সরকারের সহকারী এটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। ‘৯৭ এর কাউন্সিলে হন আইন সম্পাদক। ঢাকার ৮টি আসন ১৫টিতে উন্নীত হলে ভাগ্য খুলে যায় সাহারার। মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হন ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে।
প্রথম নারী হিসাবে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে চমকে পরিণত হন সাহারা খাতুন। কদিনের মাথায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে নির্বাচিত হন প্রেসিডিয়াম সদস্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে একটা পর্যায়ে সরালেও ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী করা হয় তাঁকে। গত নির্বাচনে বিজয়ী হন। মন্ত্রিসভায় স্থান না পেলেও দলের সর্বশেষ কাউন্সিলে আবারও প্রেসিডিয়াম সদস্য। স্বৈরাচার বিরোধী সকল আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির লড়াকু যোদ্ধা। এজন্য রাজপথে বারবার তাঁকে নিগৃহীত হতে হয়েছে। নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে বিএনপি- জামাত জোট সরকারের দুঃশাসনের আমলে। তাঁর মৃত্যুতে শুধু আওয়ামী লীগে নয় সর্বমহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি ভালো মনের মানুষ ছিলেন। জীবনটাকে উৎসর্গ করেছিলেন এই দেশের শোষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কল্যাণে। এ জন্য বেছে নিয়েছিলেন একাকীত্বের জীবন। ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে ছিলেন রাজপথে ও আদালতে বলিষ্ঠ কন্ঠ। আইনজীবী হিসাবে রাখেন বিশিষ্ট ভুমিকা। শেখ হাসিনাও তাঁকে মূল্যায়ন করেন। সাহারা খাতুন সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর এ চলে যাওয়া স্বজনপ্রিয়জনদের জন্য বিষাদ বেদনার। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। হে আল্লাহ মাবুদ! আপনি মরহুমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

সর্বশেষ