প্রফেসর ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন
আমাদের উদ্দেশ্য কি? আমাদের গন্তব্য কি? আমরা যাচ্ছি কোথায়? এমন প্রশ্ন আজ এ দেশের অনেকের মধ্যে মাথাচারা দিয়ে উঠছে। আটচল্লিশ থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে তীলেতীলে প্রস্তত করে তুলেছিলেন। বাঙালিদেরকে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাধিকার অর্জনের জন্য প্রশিক্ষিত করে আনছিলেন। এভাবেই এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু প্রশিক্ষিত জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য রণকৌশলী ঘোষণা করলেন। পাকিদের বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ করতে হবে তার একটি পূর্নাঙ্গ রূপরেখা সবার সামনে ব্যক্ত করলেন। সেদিন থেকে পাকিরা আরাে ক্ষিপ্ত হয়ে নানা কায়দায় বাঙালি নিধনে লিপ্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিরা মরণ কামড় দেয় ২৫ মার্চ কালো রাতে। জাতিকে মেধা শূন্য ও উৎকন্ঠিত ভীতসন্ত্রস্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয় পাক বাহিনী। নিরস্ত্র জনগণের উপর রাতের অন্ধকারে ঝাপিয়ে পরে পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্যতম গণহত্যার নজির স্থাপন করেছিল পাক বাহিনী। সমস্ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অবশেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর একক সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে ছাব্বিশ মার্চের প্রথম প্রহরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ও দেশবাসিকে যে কোন মূল্যে বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করার আহ্বান জানান। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ, শত্রুমুক্ত করার সংগ্রাম। বাঙালি জাতি নয় মাসের যুদ্ধে দেশকে শত্রুমুক্ত করার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে ইতিহাস সৃষ্টি করে- এত অল্প সময়ে পৃথিবীতে কোন দেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম লুটের ঘটনাও পৃথিবী ইতিহাসে বিরল। যুদ্ধ শুরুর অব্যাহতি পর থেকেই জামাতের বিশ্বাসঘাতকতায় রাজাকার, আলবদর আল-শামস বাহিনী গঠন করে বাঙালি নিধনে পাকি সৈন্যদের সহযোগিতা করা শুরু করে। সর্বসাকুল্যে একাত্তরের বিজয় দিবস পর্যন্ত স্বাধীনতা বিরোধীদের সংখ্যা ছিল অনুর্ধ্ব ৩০ হাজারের মত যা মোট জন সংখ্যার (সাড়ে সাত কোটি) শতকরা ০.০৪ ভাগ । তারপর পচাত্তরের জাতির পিতার নৃশংস হত্যার কান্ডের পর স্বাধীনতা উল্টো পথে আবার পাকি মডেলের আদলে চলতে থাকে। হারিয়ে যায় জয়বাংলা শ্লোগান, বিভক্ত হয় জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন্ দেশে কি আছে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভক্তি? কোন্ দেশে আছে জাতির পিতাকে নিয়ে বিভক্তি? একমাত্র বাংলাদেশেই আছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতির পিতা এমনকি সংবিধান নিয়ে বিতর্ক ও বিভক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার শতকরা ০.০৪ ভাগ তা স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পর দাড়িয়েছে প্রায় শতকরা ৩০ ভাগের উপরে। কেন না একাত্তরের ঘাতকদের নিষিদ্ধ করা যায় নি বলেই পচাত্তরে জাতির পিতা সপরিবারে শহীদ হন। স্বাধীনতা বিরোধীদের নিষিদ্ধ ও বিচার করা যায়নি বলেই তারা আজ প্রকাশ্যে দেশের সংবিধান, জাতির পিতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান খুবই দৃশ্যমান।
যে দেশ ইতিহাস সৃষ্টি করে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করছিল, সেই দেশে পৃথিবীর ইতিহাসকে চমকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সংবিধান ও জাতির পিতা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করেছে! এমন বিভক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে কেবল বিরলই নয়, অত্যন্ত ঘৃণিতও বটে। কাজেই মুক্তিযুদ্ধকে অর্থবহ ও কলংকমুক্ত করতে অনতিবিলম্বে শক্তিশালী কমিশন গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ও জাতির পিতার হত্যাকারীদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় এনে জামাতসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিষিদ্ধ করে স্বাধীনতাকে শত্রুমুক্ত করা না গেলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না।
প্রফেসর ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন
সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
#প্রিন্স