২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অটোপাসের বিকল্প || ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

কভিডের নতুন ভ্যারিয়ান্ট খুবই শক্তিশালী এবং অল্প সময়ের মধ্যেই রোগীকে পরাস্ত করে ফেলছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশে চলছে লকডাউন, যা এরই মধ্যে ৫ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে শপিং মল এবং যানবাহন চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে করোনার দ্বিতীয় ওয়েবের পর তৃতীয় ওয়েবের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে দীর্ঘ প্রায় ১৪ মাস পর আগামী ২৩ মে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা।

করোনার কারণে এক বছর ধরে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে কোনো রকমভাবে বাঁচিয়ে রাখা গেলেও গ্রহণযোগ্য প্ল্যাটফরমের অভাবে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কয়েকটি শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষায় জট বেঁধে আছে, এমনকি ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষাও এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে শিক্ষার্থীদের বয়স বাড়ছে, তারা হতাশায় ভুগছে এবং নানা সমস্যায় পড়ছে। এই পরিস্থিতি যদি আরও দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে করোনাকালে কীভাবে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে, তার গ্রহণযোগ্য, টেকসই ও সমন্বিত পরিকল্পনা করা জরুরি।

করোনায় সবচেয়ে সমস্যার মধ্যে পড়েছে দেশের শিক্ষা খাত। গত বছরের মার্চ মাস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করায় এ সময় স্বাভাবিকভাবে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে অনলাইনে ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। শহরাঞ্চলের নামি-দামি স্কুলগুলো নিজেরাই জুম, গুগলসহ নানা মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। কিন্তু মফস্বলে টেলিভিশন না থাকা, ডিভাইসের অভাব, ইন্টারনেটের উচ্চ দাম ও দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারেনি। ফলে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা গত বছরের পুরোটাই ছিল পড়ালেখার বাইরে। এতে শিক্ষায় বড় বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন (সিএএমপিই)-এর ২০২০-২১-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেনি। অর্থাৎ যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বাকি ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি বিরাট বৈষম্যে বা ‘লার্নিং গ্যাপ’ ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। এ ‘লার্নিং গ্যাপ’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ভয়াবহ ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে।

পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় গত বছর পিএসই, জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়। শিক্ষার্থীকে ‘অটোপাস’ দিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়। এমনিভাবে জেএসসির ২৫ শতাংশ আর এসএসসির ৭৫ শতাংশ নম্বর একত্র করে ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এবার আর ‘অটোপাস’ নয়। ২৩ মে যদি স্কুল-কলেজ খোলা যায়, তাহলে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৬০ দিন ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ৮৪ দিন ক্লাস করানো হবে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অনুযায়ী। সে ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরে এসএসসি ও ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা হতে পারে।

উল্লেখ্য, এবার দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের প্রায় ২৩ লাখ পরীক্ষার্থী এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেবে। এদিকে ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসির বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিলেও করোনার ক্ষতির ঢেউ-পরবর্তী বছরেও গড়াচ্ছে। ২০২২ সালের এসএসসি-এইচএসসি নিয়েও পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। আগামী বছর এই দুই শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের সিলেবাস কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সিলেবাস প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে ২০২২ সালের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৯ মাসের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রকাশ করেছে।

গ্রামাঞ্চল ও বিচ্ছিন্ন এলাকায় অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম ডিভাইস ও ইন্টারনেটের অভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে প্রচলিত অনলাইন ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের কিছুটা ব্যস্ত রাখলেও এর প্রভাব নিয়ে রয়েছে দ্বিধা। অর্থাৎ এই পর্যন্ত গৃহীত বিকল্প ব্যবস্থাগুলো পরিপূর্ণ পাঠদানে সফল হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। আবার এটাও ঠিক, বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন কিংবা টিভি মাধ্যমে শ্রেণিপাঠই বর্তমান অবস্থায় আদর্শ। এমতাবস্থায় শিখন-পঠনে শিক্ষার্থীদের জীবনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার মতো এবার অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কীভাবে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হয় সে বিষয়ে ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। অনলাইনে পাবলিক পরীক্ষার নেওয়ার সম্ভাব্য যাচাই এবং অন্যান্য দেশের পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতি ও ফলাফল তৈরি, বাংলাদেশে নিলে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তা যাচাই-বাছাই করার লক্ষ্যে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ করোনাকালে বিকল্প পদ্ধতিতে লেখাপড়া এবং পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তৎপর রয়েছে।

এদিকে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ১৭ মে থেকে আবাসিক হল এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ২৪ মে থেকে শুরু হবে। তবে করোনা পরিস্থিতির ওপর শিক্ষাব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত অনেকটা নির্ভর করছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ ও বয়সের দিক বিবেচনা করে এ ক্ষেত্রেও বিকল্প পদ্ধতিতে লেখাপড়া এবং পরীক্ষা মূল্যায়নের পথ বের করতে হবে। গত ডিসেম্বরে যখন ৪২তম ও ৪৩তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন জারি হয়, তখন পাবলিক ইউনিভার্সিটির কর্র্তৃপক্ষ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা গ্রহণ এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফলাফল প্রকাশ করেছিল। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি পরীক্ষা, আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অফলাইন (ল্যাব পরীক্ষাগুলো), অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, মৌখিক ইত্যাদির সমন্বয়ে নিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে করোনাকালে এভাবে পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ প্রশংসিতও হয়েছিল। এদিকে অ্যাকাডেমিক ভবন এবং আবাসিক হলগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবুও স্বাভাবিক নিয়মে (স্থগিত কয়েকটি সেশনের) পরীক্ষা নিতে গেলে চার থেকে ছয় মাস সময় লাগবে। ফলে সেশনজট আরও বাড়বে। এমতাবস্থায় অফলাইন, অনলাইন এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে হাইব্রিড বা ব্লেন্ডেড (মিশ্রিত) পদ্ধতিতে পড়ালেখা এবং পরীক্ষা চলমান রাখা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময়টুকু কাজে লাগবে এবং সেশনজট রোধে সহায়ক হবে।

হাইব্রিড বা ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া মানেই প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ আবশ্যক। সম্প্রতি ইউজিসি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইইআর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে যে ৬৫ শতাংশ গ্রামের শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, আর ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন আছে। বাকি যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের স্মার্টফোন/ডিভাইস কেনার জন্য ইউজিসি কর্র্তৃক ছাত্র প্রতি আট হাজার টাকা লোন এবং টেলিটক কর্র্তৃক ‘মাত্র ১০০ টাকায় মাসব্যাপী ইন্টারনেট’ ব্যবহারের ঘোষণায় কোনো সাড়া মেলেনি। কারণ টাকার পরিমাণ খুবই কম এবং শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে, হাওরে ও বিচ্ছিন্ন এলাকায় টেলিটকের কোনো নেটওয়ার্ক নেই। গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক দেশব্যাপী বিস্তৃত। তাই এদের সঙ্গে আলোচনা করে আপৎকালীন এ সময়ের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটকের নেটওয়ার্ক দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফরম জুম, গুগল ক্লাসরুমের, ক্যানভাস, ব্ল্যাকবোর্ড, স্কাইওয়ার্ড ইত্যাদি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। সম্প্রতি এটুআই কর্র্তৃক তৈরি ‘বৈঠক’ এবং এই ধরনের আরও দেশীয় অনলাইন প্ল্যাটফরম তৈরি করে সেগুলোকে কীভাবে জুম, গুগল ক্লাসরুমের মতো আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।

সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা সুদে (সম্ভব হলে অফেরতযোগ্য) ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগের প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের হাতে হাতে অতি দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিত। মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, ইউনিভার্সিটি এবং জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের জন্য এই অর্থব্যয় রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণই বয়ে আনবে। কারণ আজকের শিক্ষার্থীই আগামী কয়েক বছর পর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে যুক্ত হবে।

লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, অধ্যাপক ও পরিচালক আইআইটি,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

সর্বশেষ