১৭ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

“আল-কুরআন ও বিজ্ঞান” —লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

আল-কুরআন মহান আল্লাহ্ তা’আলার বাণী। মানব জাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ আসমানী গ্রন্থসমূহের মধ্যে আল-কুরআন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। কুরআনের পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের সারবস্তু এবং পৃথিবীর সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান তার মধ্যে সন্নিবিষ্ট আছে বলেই তাকে কুরআন বলা হয়। কুরআনের অপর একটি নাম আল-হাকীম অর্থাৎ জ্ঞান ভান্ডার। মানুষের প্রয়োজনীয় এমন কোন বিষয় নেই, যা এই কুরআনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং আল-কুরআনকে ৫৫টি নামে পরিচিহ্নিত করেছেন। প্রত্যেকটি নামের মধ্যেই এই কিতাবের গুণাবলী, অনন্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখিত এসব নামের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন মাজীদকে হাকিম(বিজ্ঞানময় বা জ্ঞানভান্ডার)

ফোরকান (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী), আয্যিকর (উপদেশ) আন্নূর (জ্যোতি) প্রভৃতি নামে সম্বোধন করেছেন। এক কথায়, আল-কুরআন হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ মানবজাতির হিদায়াতের মহাগ্রন্থ।বিজ্ঞান যেহেতু মানবীর তৎপরতা ও মানবজাতির অগ্রগতির জন্য আল্লাহ্ তা’আলা প্রদত্ত একটি বিশেষ জ্ঞান, তাই কুরআনের প্রায় সর্বত্রই জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রকৃতি পরিবর্তন, বিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। অথচ অজ্ঞতার কারণে অনেকেই বিজ্ঞানকে ধর্মীয় বিষয়ের অঙ্গীভূত বলে মনে করতে চান না। বিজ্ঞানের যতই উৎকর্য সাধিত হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার পরিচয় ও তাঁর সৃষ্টি রহস্যের সূক্ষাতিসূক্ষ বিন্যাস ও কৌশলের সাথে পরিচিত হয়ে মানুষ ততই আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

বর্তমান সময়কে বলা হয় বিজ্ঞানের উৎকর্যের যুগ। বিজ্ঞানকে জানা মানে আল্লাহ্ ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জানা, আল্লাহ্র সৃষ্টি রহস্যের সাথে পরিচিত হওয়া, আল্লাহ্র দেয়া বিশেষ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব প্রকৃতি ও মানবতার কল্যাণ সাধন করা। এ যুগের তরুণ প্রজন্ম বিজ্ঞান প্রযুক্তির আবহে বেড়ে উঠছে, ফলে তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই জানতে হবে যে, মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হচ্ছে আল্লাহ্র নিয়ামত, দিক-নির্দেশনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অনন্ত ভান্ডার, তাহলে তারাই সর্বাগ্রে আঁকড়ে ধরবে এই পবিত্র কুরআনকে এবং এর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে তাদের মেধা ও মনন। অন্যথায় তারা হবে বিভ্রান্ত। পবিত্র কুরআনের মোট আয়াত সংখ্যার মধ্যে প্রায় এক-অষ্টমাংশই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে নিবেদিত হয়েছে। কুরআন আক্ষরিক অর্থে কোন বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়, কাজেই বিজ্ঞানের সকল নীতিই এর মধ্যে হুবহু সন্নিবিষ্ট পাওয়া যাবে এমন আশা করা যেতে পারে না। তবে প্রকৃত ঘটনা ও বিজ্ঞানের সূত্র নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে কুরআনের নিজস্ব ভঙ্গিমা রয়েছে। এটি বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহের মূল প্রতিপাদ্য তুলে ধরে এবং বেশ কিছু ঘটনা বা সত্য সম্পর্কে ইঙ্গিত ধর্মী বক্তব্য প্রদান করে। যাতে থাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক সূত্রসমূহ সম্পর্কে পরিষ্কার ইঙ্গিত। কুরআনের একটা বক্তব্য কোন একটা নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক বিষয়ে ব্যাপক কথা তুলে ধরে।

একটি দৃষ্টান্ত বিষয় স্পষ্ট করে তুলতে পারে। আল্লাহ্র পবিত্র কুরআনে বলেন “আমি কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করি নাই”। এই যে ঘোষণা, প্রকৃতপক্ষে এটি একজন আধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞানীর সর্বপ্রথম মৌলিক বিশ্বাসের বিষয়বস্তু, যিনি উপলব্ধি করেন এই মাহবিশ্বের একটা সূক্ষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে যাতে আমাদের বিঘœ সৃষ্টি করা উচিত নয়।

পৃথিবীতে প্রায় ৩ কোটি প্রকারের জীবদেহ রয়েছে। এ পর্যন্ত মাত্র ৫০ লক্ষের উপর গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। এ সকল জীবদেহের অনেকগুলোরই কার্যগত উপযোগিতা কী তা আমরা জানি না। অবশ্য অনেক সময়ই দেখা গেছে, এ সকল জীবদেহের জীবনধারায় মানুষ বিঘœ সৃষ্টি করে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি আমরা যদি নাও জানি কোন বিশেষ প্রজাতির জীবদেহের কাজ কী, তবুও এটি যাতে টিকে থাকতে পারে সেদিকে আমাদের সর্বাধিক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ এই প্রজাতি বিলুপ্ত বা উচ্ছেদ হলে তা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। ফলে দেখা যায় যে, পরিবেশ বা বাস্তুসংস্থান বিজ্ঞানের পরিপূর্ণ ভিত্তি কুরআনের এই ঘোষণা ব্যতীত আর কিছু নয় যে, কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করা হয়নি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, “তিনিই সেই সত্তা যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে বিন্যাস করেছেন সঠিক অনুপাতে”। সূরা “আল-মু’মিনূন”-এ ভ্রুণ স্তর থেকে ধাপে ধাপে মানব শিশু কিভাবে বেড়ে পূর্ণাঙ্গ মানবে পরিণত হয় তার উল্লেখ রয়েছে। এ সকল ধাপের কথা আল-কুরআনে বলা হয়েছে ৭ম খ্রিষ্টাব্দে যখন ভ্রুণতত্ত্ব বিজ্ঞানের উদ্ভাবনই ঘটেনি। ভ্রুণতত্ত্ব বিজ্ঞানের শাখা গড়ে উঠেছে মাত্র ১০০ বছর হয়েছে। পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত মানব ভ্রুণের ধাপে ধাপে বৃদ্ধির বিষয়টি মাত্র সম্প্রতি আবি®কৃত হয়েছে। আল্লাহ্ মানুষকে তাঁর সৃষ্টি এবং এর উন্নয়ন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে বলেছেন, যেন মানুষ জীববিদ্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং জীবনের রহস্য উন্মোচন করতে পারে। আমরা যাকে সৃষ্টিজগৎ বলে থাকি, তা আল্লাহরই এক প্রকার স্মারকচিহ্ন বা নিদর্শন। বিজ্ঞান মানুষকে এই স্মারকচিহ্নই বুঝতে সাহায্য করে। সাধারণভাবে জ্ঞান এবং বিশেষভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অবশ্যই ধর্মের সাথে সাথেই চর্চা করতে হবে। বস্তুত কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী বিজ্ঞান অন্যান্য মানবিক কর্মতৎপরতার মতই ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেখানে বিজ্ঞান আমাদেরকে শিক্ষা দেয় কীভাবে প্রকৃতি কাজ করে এবং এই শিক্ষা আমাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য উৎপন্ন দ্রব্য ও প্রক্রিয়া কাজে লাগাতে সক্ষম করে। তেমনি ধর্ম আমাদেরকে শিক্ষা দেয় সেই সকল মূল্যবোধ যা আল্লাহ্ আমাদেরকে চর্চা করতে বলেন যাতে জীবনের মূল্যবোধ ও উপযোগিতার দিকগুলো সুসমন্বিতভাবে সংমিশ্রণ ঘটানো যায়। কাজেই বলা যায় যে, বিজ্ঞান ও ধর্ম উভয়ই প্রয়োজন। বিজ্ঞান বস্তুগত জ্ঞান দান করে, ধর্ম সেই জ্ঞানকে ব্যবহারের মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়। ধর্ম মানুষকে আহ্বান জানায় সৃষ্টিজগৎ ও স্রষ্ট্রা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে। বিজ্ঞান সৃষ্টিকে বুঝার মত জ্ঞান দান করে এবং সৃষ্টিই স্রষ্টার নিদর্শন হিসেবে কাজ করে। বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কোন বিরোধ নেই। মূলতঃ আল-কুরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যেও কোন বিরোধ নেই। তবে পবিত্র কুরআন আল্লাহ্র বাণী, অপরিবর্তনশীল ও সংরক্ষিত। আর মানুষের গবেষণা ও অক্লান্ত অনুশীলনের ফলে গড়ে উঠেছে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞানসহ মানবজীবনের সকল কর্মতৎপরতাই আল-কুরআনের আওতাভুক্ত।

লেখক পরিচিতি ঃ

লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল

(শিক্ষক, কলামলেখক, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক)

সভাপতি, টেপিরবাড়ী পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ, শ্রীপুর, গাজীপুর।

সভাপতি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি

সর্বশেষ