১২ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সংবাদ শিরোনাম

করোনা রোগীর চিকিৎসায় প্রাথমিক পরামর্শ দিতে পারবে শাওনের তৈরি রোবট

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

আরিফিন রিয়াদ, বরিশাল-১ প্রতিনিধি ॥ মহামারী করোনার সংক্রমণ নিয়ে গোটা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। অনেকেই সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর কাছে যেতে চান না। আবার করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে যারা যাচ্ছেন তাদের মধ্যে বহু আত্মীয়-স্বজন, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে রোবট উদ্ভাবন করেছে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের ভদ্রপাড়া গ্রামের দেলোয়ার সরদারের পুত্র সরকারী গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শাওন সরদার সোলাইমান। তার উদ্ভাবিত রোবট করোনা রোগীর বেডের পাশে গিয়ে তার চিকিৎসায় প্রাথমিক পরামর্শ দিতে পারবে।

করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবাই। চলমান পরিস্থিতিতে অনেকেই করোনায় আক্রান্ত রোগীদের কাছে যেতে দ্বিধাবোধ করছেন সংক্রমিত হওয়ার আতঙ্কে। এমন সব পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে চিকিৎসকের সহায়ক হিসেবে ‘মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট’ নামে ‘রোবট’ উদ্ভাবন করেছেন স্কুলছাত্র শাওন সরদার সোলাইমান।

দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শাওন সরদার সোলাইমান জানান, ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয়, তখন সে বিভিন্ন হৃদয়বিদারক দৃশ্য ও ঘটনা জানতে পারে। যেমন আক্রান্ত হলে মায়ের কাছে সন্তান যাচ্ছেনা, বাবা-মাকে ফেলে রেখে যাচ্ছে সন্তানরা ইত্যাদি। তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবার জন্য একটি ‘রোবট’ তৈরি করবে। এরপর অনলাইনে ‘রোবট’ উদ্ভাবনের ভিডিও দেখে সে মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্টের সিস্টেম ডেভেলপ করতে শুরু করে।

মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়া শাওন আরও জানায়, ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সে চূড়ান্তভাবে রোবট বানানোর কাজ শুরু করে। পর্যায়ক্রমে নিজেই এর ডিজাইন তৈরি করে নাম দিয়েছে ‘মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট’। এখন রোবটটি তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা সহায়ক সেবাগুলো দিতে পারে সেই প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ চলছে। এতে করে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এ রোবট করোনায় আক্রান্ত রোগীর বেডের পাশে গিয়ে চিকিৎসাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিতে পারবে। আবার রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠানামা দেখা, রোগীর অবস্থান থেকে দূরবর্তী কোথাও চিকিৎসক থাকলে তাকেও সরাসরি ভিডিও’র মাধ্যমে দেখাতে পারবে। রোবটের পাঠানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নতুন কোন পরামর্শ রোগীকে দিলে বা করোনায় আক্রান্ত রোগী চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে রোবট তা বলিয়ে দেবে। ফলে চিকিৎসকরাও থাকবে ঝুঁকিমুক্ত।

শাওন বলে, পরিবার থেকে দেয়া হাত খরচের প্রায় ১৮ হাজার টাকা ব্যয়ে এ মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট নামক রোবটটি তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্টের সিস্টেম ডেভেলপের কাজ শেষের পথে। পুরো কাজ সম্পন্ন করা হলে এটি দেশে করোনা মোকাবেলায় কাজে আসবে।

করোনা আক্রান্ত রোগীর কাছে না গিয়ে ঔষধ সরবরাহ ও তথ্য সংগ্রহের কাজে রোবটটি তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে যন্ত্রটি বড় ভূমিকা রাখবে। রোবটটি চিকিৎসক ও নার্সদের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে। চিকিৎসক তার কক্ষে বা অন্য কোথাও বসে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রোবট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

এছাড়া করোনা ভাইরাস সংক্রমিত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে না গিয়েও তাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন ঔষধ, খাদ্য সরবরাহ করা যাবে। এর সেন্সরের সামনে রোগীর মাথা রাখলে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী মনিটরে দেখা যাবে।

তিনি আরও বলেন, এতে বিশেষ ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ও স্পিকার সংযুক্ত করা আছে। যার মাধ্যমে রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান করা যাবে। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে যেকোনো স্থান থেকে একে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

শাওনের বাবা দেলোয়ার সরদার স্থানীয় বাজারে জুতার ব্যবসা করেন। শারীরিকভাবে আংশিক প্রতিবন্ধী দেলোয়ার ছেলের উদ্ভাবন দেখে খুশি হলেও মনে আফসোসও আছে তার। দেলোয়ার বলেন, ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করতো শাওন। নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই নিজে নিজে বলতো সে রোবট তৈরি করবে। আমরা তখন বিষয়টি হাস্যরস করে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু ওর স্কুলে যাওয়ার জন্য যে হাত খরচ দিতাম সেই টাকা জমিয়ে দিনে দিনে দেখছি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে একটি রোবট তেরি করেছে।

তিনি আরও বলেন, শাওনের রোবট সব ভাষায় কথা বলতে পারে। এর সব সিস্টেমই মোবাইল দিয়ে করেছে সে। তবে আমার আফসোস ছেলেকে একটা কম্পিউটার কিনে দিতে পারিনি। পারলে আরও দারুণ কিছু আবিষ্কার করতে পারতো।
শাওন বলে, আমি মূলত ভিন্ন কিছু নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। যে রোবট আমাদের বড় ধরণের সমস্যার সমাধান করতে পারবে তা নিয়েই কাজ করছি। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের সিস্টেম ডেভেলপ করলে দেশে করোনা মোকাবেলায় এটি কাজে আসবে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় শাওন। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুবাদে রোবট উদ্ভাবনের চিন্তা মাথায় আসে তার। ভবিষ্যতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় শাওন।

সরকারী গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জহিরুল হক বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার ওপর আমরা বেশি গুরুত্ব আরোপ করছি। যে কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখছে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শাওনের উদ্ভাবন ও এগিয়ে যাওয়ায় আমরা গর্বিত।
এ বিষয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবুল হাশেম বলেন, উপজেলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এটি আনন্দের সংবাদ। আমরাও তাদের সহায়তা করতে চাই। এই সব ক্ষুদে প্রযুক্তিবিদরা এক সময়ে বড় বিজ্ঞানী হবে বলে আমার বিশ্বাস। যারা রোবট নিয়ে কাজ করছে তারা সহায়তার আবেদন করলে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সহায়তার চেষ্টা করব।

সর্বশেষ