১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কর্মীসমর্থকরা ভীতি-আক্রান্ত হয়ে নেতার অধীন হলেও স্থায়ী হয়না !

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

সোহেল সানি :

মানুষ ততক্ষণ ক্ষমতা পছন্দ করে যতক্ষণ তারা বিশ্বাস করে যে, রাষ্ট্রপরিচালনা করবার যোগ্যতা তাদের নেতার আছে। অনেক সময় সাধারণ শান্ত মানুষ ভীতি-আক্রান্ত হয়েও নেতার অধীন হয়। কিন্তু এ অধীনতার স্থায়ীত্ব নেই।
দলের ভেতরে যখন নেতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সম্ভাব্য বিদ্রোহীদের মধ্যেও নেতা ভীতি জাগিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু সেই কর্তৃত্বের প্রতি জনগণের স্বীকৃত অনস্বীকার্য। নেতার মধ্যে আত্মবিশ্বাস, দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নের গুণাবলী থাকতে হয়। অবশ্য এটা নেতৃত্ব সাপেক্ষ বিষয়।। যেমন ক্যান্টনি যাতে মান্য করে সেজন্য সিজার তাঁকে বাধ্য করতে পারতেন। যেমন জিন্নাহকে ভারতীয় রাজনীতি এক অনন্য উচ্চতায় অবতীর্ণ করেছিলো। মুসলিম লীগে তার কর্তৃত্ব এমন ছিলো যে, তার মুখের ওপর কথা বলা ছিল ঔদ্ধত্যের। যে কারণে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে জিন্নাহর নির্দেশে স্বাধীন যুক্তবাংলার স্বপ্ন বাদ দিয়ে ‘দিল্লির মুসলিম লীগ কনভেনশনে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ উত্থাপন করতে হয়। এমনকি মুসলিম লীগের নাম ‘জাতীয়তাবাদী লীগ’ রাখার দাবি করায় সোহরাওয়ার্দীকে গণপরিষদ সদস্য পদ হারাতে হয়।
প্রবল ক্ষমতাধর সেই গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ শেষ জীবনে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার পর ভাবশিষ্য প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান সুচিকিৎসার ব্যবস্থাটি পর্যন্ত করেননি। একটিবার হাসপাতালে দেখতে পর্যন্ত যাননি। পাকিস্তানের জাতির পিতার লাশ করাচী এয়ারপোর্টের বারান্দায় পড়ে ছিলো চরম অযত্নে- অবহেলায় ঘন্টার পর ঘন্টা। এর কারণ জনগণের অন্ধমোহ কেটে গিয়েছিল। পূর্বপাকিস্তানও ততদিনে জিন্নাহর প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। এক বাংলাভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণেই।
ভারত জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে শেষ জীবনে নেহেরু সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের জন্য অনশণে গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন দিতে হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী- শরত বসুর স্বাধীন যুক্তবাংলার পক্ষে সমর্থন দিতে গিয়ে গান্ধীজীকে কংগ্রেস কর্তৃক তিরস্কৃত হতে হয়েছে। অথচ মওলানা আবুল কালাম আজাদের পদত্যাগের পর কংগ্রেসের সভাপতি পদে বল্লভ ভাই প্যাটেল বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। কিন্তু গান্ধীজীর কর্তৃত্ব পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুকেই সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত করেছিলো। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়
সোহরাওয়ার্দী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ আবার কী, আমিই আওয়ামী লীগ। তখন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনার বক্তব্য আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো পরিপন্থী কিনা? রেগে গিয়ে সোহরাওয়ার্দী বলেন,’আমিই গঠনতন্ত্র, আমিই মেনিফেস্টো।’
সোহরাওয়ার্দী সরকারের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ এক গ্রন্থে লিখেছেন, নেতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি। এটা দিবালোকের মতো যে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কিন্তু নেতার বক্তব্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও মর্মাহত হয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধুরও মুখে সম্মুখে দাঁড়িয়ে কারো টু-টা শব্দ করার সুযোগ ছিলো না। এমন এক উচ্চতায় তিনি পৌঁছেছিলেন। তিনি জাতির পিতা। তাঁকেই দেখতে হয়েছে প্রবল বেদনা নিয়ে জাসদের তান্ডব। শুনতে হয়েছে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তাঁকে উৎখাতের কথা। তাঁকে হজম করতে হয়েছে ‘গায়ের চামড়া দিয়ে ঢুকডুগি বাজানোর’ ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য। ডাকসুর সদস্য পদ কেড়ে নেয়া, বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা উপাধি কেড়ে নেয়ার হুমকি ইত্যাদি।
আমেরিকান জাতির পিতাকেও জীবদ্দশায় কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। ডোপ টেস্ট করা হয় তাঁর মৃত্যু কামনা করে। কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয় রাজ্যে রাজ্যে। বহু জাতির পিতা ও মহানায়ককে স্বদেশের খুনীদের হাতে জীবন দিতে হয়েছে।
রাজনীতির লীলা-লাস্য বড়ই মধুর, বড়ই নিষ্ঠুর।
“মুজিবের মানসিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং গুণাবলী,পরিমাণে কিছুটা কম হলেও,তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বে প্রতিভাত হয় (“For the spirit of Mujib is there, though diminished, in the personality of his daughter, Sheikh Hasina, who leads the party (Awami League) now”- The Gurardian, London, 11 July 1981) ১৯৮১ সালের ১১ জুলাই গার্ডিয়ান এ মন্তব্য করে।
রাজনীতি ও রাজনীতির নানা বিষয়কে শেখ হাসিনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার ক্ষেত্রে পিতা শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিলো না। কিন্তু প্রচ্ছন্নভাবে তাঁর কন্যার চোখে স্বাধীনতা ও সক্রিয়তাবাদের একটা আদর্শ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলেন। পিতার স্নেহাবেশে সমকালীন রাজনৈতিক ধারা, আওয়ামী লীগের গৌরবোজ্জ্বল যৌবনের সংগ্রামমুখর কর্মকাণ্ড এবং পূর্বাপর জাতীয় নেতাদের রণনীতি ও রণকৌশল স্বচক্ষে দেখেছেন, হাতে-কলমে শিখেছেন এবং গড়ে উঠেছেন সেভাবেই।
জাতির পিতার সর্বাধিক কাছে থাকার সুবাদে স্নেহধন্য হয়ে একধরনের “প্রচ্ছন্ন বড়ত্ব” অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শেখ হাসিনার মাঝে থাকা সেই “প্রচ্ছন্ন বড়ত্ব” তাঁকে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সমাসীন করে।
যে পর্দার আড়ালে ঢেকে দেয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের সুনাম ও ঐতিহ্যের একেকটি ধারা, সেই পর্দার একেকটি স্তর নিজের তীক্ষ্ণবুদ্ধির ছুরি দিয়ে একটা একটা করে কেটে ফেলে আওয়ামী লীগকে আবার “জনগণের দল” হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার পুরো কৃতিত্ব শেখ হাসিনার।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার আগমন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করে। এরশাদের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে তাঁর অবদান তরঙ্গশীর্ষে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং দেশে মূলধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে তাঁর ভুমিকা অবিস্মরণীয়।
কিন্তু চক্রান্ত ষড়যন্ত্র তার পিছু ছাড়েনি। ১৯ বার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। চলতি মেয়াদ পূর্ণ হলে তাঁর দেশ শাসনের ২০ বছর পূর্ণ হবে। আওয়ামী লীগই বলছে দলে অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। কিন্তু তাদের মূল উৎপাটনের কোনো প্রক্রিয়া কী আছে? অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধরা পড়ার বলা হচ্ছে এরা অনুপ্রবেশকারী। এরা পদপদবীওয়ালা নেতা হওয়ার পরও এটা বলা কতটা যুক্তিনির্ভর সেই প্রশ্ন এসে যায়!

লেখকঃ

সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সর্বশেষ