২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চোখের পানিতে শেষ বিদায় বাংলাদেশি বিস্ময় তরুণের

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

চোখের পানিতে সন্তানকে কবরে শুইয়ে দিলেন হতভাগ্য পিতা। স্বজন এবং বন্ধুরাও শেষ বিদায় জানিয়েছেন দু’চোখে অশ্রু ঝরিয়ে। নৃশংসভাবে খুন হওয়া প্রযুক্তি-জিনিয়াস ফাহিম সালেহ (৩৩) এর দাফন সম্পন্ন হয়েছে নিউ ইয়র্কে। এর আগে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় তার নামাজে জানাযা। স্থানীয় সময় রোববার দুপুর ১টার দিকে নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরের আল নূর মুসলিম সিমেটারি কবরস্তানে তাকে চিরশয্যায় শায়িত করা হয়। এটি নিউ ইয়র্ক স্টেটের ছোট্ট শহর নিউ উইন্ডসরের প্লিজেন্ট হিল রোডে অবস্থিত। পুকেপসি-হোপ ওয়েল জংশনে অবস্থিত ফাহিমদের পারিবারিক বাসভনের বেশ কাছেই কবরস্তানটি।
এর আগে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এনওয়াইপিডি) কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে এবং ফিউনারেল হোমের ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফাহিমের মৃতদেহ কবরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

তার আগ পর্যন্ত মৃতদেহটি পুলিশের হেফাজতে ছিল। গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা দাফন শেষ হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।
জানাযা ও দাফনকাজে অংশগ্রহণকারীদের একজন আলবেনির বাসিন্দা আতাউর বাবুল। তিনি ফাহিম সালেহ’র ফুফাতো ভাই। আতাউর বাবুল মানবজমিন প্রতিনিধিকে জানান, করোনাজনিত পরিস্থিতিতে প্রশাসনের বিধি-নিষেধের কারণে কেবল পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও ফাহিমের কিছু স্কুল-বন্ধু দাফনকাজে অংশ নেয়। এতে অংশ নেয়ার ব্যাপারে আরও বহু মানুষ আগ্রহ প্রকাশ করলেও প্রশাসনিক বিধি-নিষেধের কথা বিবেচনায় রেখে তাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছিল না আসার জন্য। তারপরও প্রায় ১২০ জনের মতো মানুষ উপস্থিত হয়। এরমধ্যে ফাহিমের স্কুল-বন্ধুদের কয়েকজন, যারা পুকেপসি-ফিশকিলে অবস্থিত জন জে হাইস্কুলের সাবেক ছাত্র, তারাও উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার সংক্ষেপে ফাহিমের স্মৃতিচারণ করে বক্তব্যও দেয়। সবার চোখেই ছিল পানি। কাঁদতে কাঁদতেই ছেলের জন্য দোয়া চেয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন ফাহিমের বাবা সালেহ আহমেদ। এরপর জানাযার নামাজ পরিচালনা করেন স্থানীয় ওয়েপিংগার ফলস আল নূর জামে মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারের ইমাম উসমানী। প্রশাসনের বেঁধে দেয়া শারীরিক দূরত্বের বিধান মেনে সবাই ৬ ফুটের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে সম্পন্ন করে জানাযা ও দাফনের আনুষ্ঠানিকতা।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাইডশেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ গত ১৩ জুলাই নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে তার নিজ এপার্টমেন্টে খুন হন। হত্যার একদিন পর তার মৃতদেহ ইলেক্ট্রিক করাত দিয়ে কেটে কয়েক টুকরো করা হয়। খুনী এদিন মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ আলাদভাবে গার্বেজ ব্যাগে ভরে ওই ভবনেরই ময়লার সুড়ঙ্গে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই ফাহিমের খালাতো বোন মীরান চৌধুরী ওই এপার্টমেন্ট ভবনে পৌঁছে কলিং বেল বাজালে খুনী পেছনের দরজা ব্যবহার করে সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে যায়। ওইদিনই বিকেল বেলায় পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ফাহিম সালেহ’র খন্ড-বিখন্ড মৃতদেহ উদ্ধার করে।
এরপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারমূলক তদন্তে মাত্র তিনদিনের মধ্যেই খুনীকে চিহ্নিত এবং গ্রেফতার করে এনওয়াইপিডি। অচেনা কেউ নয়, ফাহিমেরই দীর্ঘদিনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, তার সদ্যসাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস ডি হ্যাসপিল (২১) অভিযুক্ত হয় তার বসকে খুন করার দায়ে। গত শুক্রবার সকাল পৌনে ৯টায় ফাহিমের এপার্টমেন্টের অনতিদূরেই আরেকটি এপার্টমেন্ট থেকে গ্রেফতার করা হয় এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে। ফাহিমকে হত্যার দু’দিন পর পাঁচদিনের জন্য এই দামী এপার্টমেন্ট ভাড়া করে খুনী। এখানে সে অবস্থান করছিল বান্ধবীসহ। এর আগে ফাহিমের তহবিল থেকে গোপনে প্রায় ৯০ হাজার ডলার সরিয়ে নেয়ার ঘটনা ধরা পড়ার পর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় কিছুদিন আগে। গ্রেফতারের পর শুক্রবার গভীর রাতে টাইরেস হ্যাসপিলকে উপস্থাপন করা হয় ভার্চুয়াল আদালতে। দু’পক্ষের শুনানীর পর বিচারক জনাথন সভেটকি জামিনের সুবিধা ছাড়াই তাকে কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দেন। আগামী ১৭ আগস্ট তাকে আবার কোর্টে হাজির করার জন্য বলা হয়েছে।
ফাহিম সালেহ’র বাবা সালেহ আহমেদ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন ডাকসু’র সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর জাসদের জন্ম হলে তিনি প্রতিষ্ঠালগ্নেই যুক্ত হন এই দলের সঙ্গে। সাংবাদিকতাও করেছেন দৈনিক গণকন্ঠে। সত্তরের দশকের শেষদিকে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে যান সৌদি আরব। দীর্ঘদিন সেখানেই ছিলেন। ১৯৮৬ সালে ফাহিম সালেহ’র জন্মও হয় সৌদি আরবেই। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে ফাহিম দ্বিতীয়। এরপর ১৯৯১ সালে পরিবার নিয়ে সালেহ আহমেদ পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে জেরোক্স কোম্পানির চাকরি নিয়ে থাকতে শুরু করেন নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে প্রায় ২০০ মাইল দূরের রচস্টার শহরে। ফাহিম সালেহ’র প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল কেটেছে সেখানেই। এরপর এক সময় আইবিএম কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে রচস্টার ছেড়ে নিউ ইয়র্ক সিটির অনেকটা কাছেই পুকেপসি শহরে চলে আসেন তিনি। এখানকারই জন জে হাইস্কুলে ভর্তি হয় ফাহিম। এই স্কুলের ছাত্র অবস্থায়ই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নানা রকম উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় সে। স্থানীয় দেড় শ’ বছরের পুরনো পত্রিকা পুকেপসি জার্নাল তাকে নিয়ে একাধিকবার কভার স্টোরি করে। হাইস্কুল শেষ করার আগেই প্রাংকডায়াল নামে নতুন ধরণের একটি যোগাযোগ অ্যাপ তৈরি করে সাড়া ফেলে দেয় ফাহিম। বানিজ্যিকভাবেও দারুন সফল হয় এটি। পরবর্তী কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে প্রাংকডায়াল। এর মাধ্যমে অতি অল্প বয়সেই প্রযুক্তি জগতে রীতিমতো সাড়া ফেল দেয় সে। জন জে হাইস্কুল শেষে করে উচ্চশিক্ষার জন্য ফাহিম চলে যায় ম্যাসাচুসেটসের বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে ইনফরমেশন সিস্টেমের ওপর ডিগ্রি নেয়ার পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশে গিয়ে অন্য দুই সহউদ্যোক্তার সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন পাঠাও। এটি ইতিমধ্যেই দারুন সফল একটি উদ্যোগ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালে পাঠাও ছেড়ে চলে আসেন ফাহিম। এরপর তিনি চলে যান নাইজেরিয়াতে। সেখানকার সবচেয়ে জনবহুল সিটি লাগোসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পাঠাও এর মতোই আরেকটি মোটরসাইকেল ট্যাক্সি সার্ভিস ‘গোকাডা’। পাশাপাশি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে প্রতিষ্ঠা করেন ভেনচার ক্যাপিটাল কোম্পানি অ্যাডভেনচার ক্যাপিটাল। এই প্রতিষ্ঠানটি কলম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে নতুন যুগের রাইডশেয়ারিং স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে।
ফাহিম সালেহ গত বছর ম্যানহাটনের লোয়ার ইস্টসাইডে ২৬৫ ইস্ট হাউস্টন স্ট্রিটের একটি অভিজাত কন্ডোমেনিয়াম ভবনে প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলারে ক্রয় করেন একটি বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট। এর আগে তিনি ম্যানহাটনেই নিজের কেনা অন্য একটি এপার্টমেন্টে বসবাস করতেন। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর আগে ফাহিম নাইজেরিয়াতে ছিলেন। মার্চ মাসের গোড়ার দিকে সেখান থেকে ফেরার পর থেকে তিনি পুকেপসিতে পরিবারের সঙ্গেই ছিলেন। খুন হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে গিয়ে ওঠেন নিজের নতুন এপার্টমেন্টে। সেখানে তিনি একাই থাকতেন। নিজের খুব পছন্দের এই এপার্টমেন্টেই ফাহিম নিমর্মভাবে খুন গত ১৩ জুলাই। সেইসঙ্গে থেমে যায় দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলা এক বিস্ময়কর তরুণ প্রযুক্তি-উদ্যোক্তার নিত্য-নতুন উদ্ভাবনের ধারা। শেষ হয়ে যায় দুনিয়াবাসীর সামনে নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবার মতো এক অমিতসম্ভাবনা।
ফাহিমের নৃশংস এই হত্যাকান্ড দুনিয়াজুড়েই সৃষ্টি করে আলোড়ন। গোটা দুনিয়ার সকল গণমাধ্যমেই খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয় এ সম্পর্কিত সংবাদগুলো। নিউ ইয়র্ক টাইমস বা সিএনএন এর মতো দুনিয়ার শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ফাহিম হত্যাকান্ড ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের খবর প্রচার করে।

সর্বশেষ