মুহাম্মাদ ইমাদুল হক (প্রিন্স)
সরকারি চাকরিজীবীরা আসবেন, আবার বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাবেন- এটাই নিয়ম। সরকারি দপ্তরগুলোর কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, স্কুল-কলেজসহ আরও কত শত মানুষের পক্ষ থেকে আসা ফুল বলে দিচ্ছে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ফুলে ফুলে ভরে গেছে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও তার বাংলো।
বিদায়টা কেমন হয় সরকারি অন্যসব চাকরিজীবীর যেন সেই বিষয়টিও নমুনা হিসেবে রেখে গেলেন ঝালকাঠির বিদায়ী জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মোঃ জোহর আলী, বর্তমান জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (যুগ্ম সচিব) । গত এক সপ্তাহে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে শতাধিক বিদায় অনুষ্ঠান হয়েছে। এতো বিদায় অনুষ্ঠান, এতো ফুল আগে কখনো দেখেননি কোনো জেলা প্রশাসক। আর তাকে নিয়ে আয়োজিত এমন কোনো বিদায় অনুষ্ঠান নেই যেখানে মানুষ কাঁদেনি। শুধু কি ঝালকাঠি জেলার মানুষ কেঁদেছেন, পাশাপাশি কেঁদেছেন মোঃ জোহর আলী নিজেও। বিদায় বেলায় এতো দিনের সহকর্মীরাও কেঁদেছেন।
তিনি জেলা প্রশাসক হিসেবে তিন’বছর পাঁচমাস ১২ দিন অত্যন্ত সফলভাবে ঝালকাঠিতে কর্মরত থেকে আজ ৪ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রি. পূর্বাহ্নে ঝালকাঠি থেকে বিদায় নিলেন। রবিবার সকালে নবাগত জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম এর হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে দুপুর ৩টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন তিনি।
এমন সজ্জ্বন আর নির্মোহ মানুষের বিদায়ে ঝালকাঠির সর্বস্তরের জনগণকে শোকাবহ করে এই নিরেট আর ভাল মানুষটি বিদায় নিলেন।
না এটা তাঁর কোন অস্বাভাবিক বদলি নয়। স্বাভাবিক নিয়মে তিনি জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (যুগ্নসচিব) হিসেবে পদায়িত হয়েছেন। তাঁর পরিবর্তে আজ সেখানে যোগদান করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জনাব ফারহা গুল নিজুম।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তথা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে জেলা প্রশাসকের পদটি জেলার অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যমণ্ডিত ও সম্মানিত। সরকার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই পদটির মর্যাদা অনেক বেশি। সাধারণভাবে অধিকতর যোগ্যতা বিবেচনায় অনেক terms & conditions আলোচনা পর্যালোচনা করে জেলা প্রশাসক হিসেবে সরকারের উপসচিবদের মধ্য থেকে এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্য হতে যাঁরা জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান তাঁরা সত্যিই ভাগ্যবান!
জেলা প্রশাসকের পদটি যেমন সম্মানীয় ও মর্যাদাসম্পন্ন তেমনি এই পদের সম্মান ও মর্যাদা ধরে রাখার জন্যে জেলা প্রশাসককে প্রতি মুহুর্তে চোখ কান খোলা রেখে কাজ করতে হয়।
পান থেকে চুন খসলে এই পদধারী মানুষটিকে বড় ধরনের মাশুল গুণতে হয়। পাশাপাশি এই পদে যাঁরা অধিষ্ঠিত হন তাঁদের অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে, মানুষের সেবা করার এবং মানুষের ভক্তি ও ভালবাসা পাবার।
সার্বিক বিবেচনায় আমাদের ঝালকাঠির বিদায়ী জেলা প্রশাসক, মোঃ জোহর আলী মহোদয় ছিলেন শতভাগ সফল, কোন সন্দেহ নেই।
আমার আব্বু শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক (আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোঃ আব্দুল ওহাব সাহেব খুলনার হুজুর রহঃ) এর নামে আমার এলাকার (নলছিটি উপজেলার ৭নং নাচনমহল ইউনিয়নের) একটি সড়কের নামকরণে আমাদের এলাকাবাসীদের আবেদনের সূত্রে বিদায়ী জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে আমার এবং আমার বড় বোন নলছিটি সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কবি ও সাহিত্যিক মাহমুদা বেগমের আলাপ হলেও সেটা পরিচয় তথা ঘনিষ্ঠতায় রূপলাভ করে মাত্র ছয় মাস যাবত। এই ছয় মাসের মধ্যে আমার স্বার্থে মাত্র দু’বার এবং আমার বড় আপু মাহমুদা বেগম তার কলেজ এবং জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের কারণে বেশ কয়েকবার উনার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ হয়েছে, আর সেকারণে আমরা উনাকে চিনেছি, দেখেছি এবং বুঝেছি নিবিড়ভাবে।
মানুষকে কি করে সম্মান দিতে হয় সেটার এতটুকু কমতি ছিল না তাঁর মধ্যে। ঝালকাঠি জেলাতে আমার বাড়ি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অফিসার হিসেবে এবং আমার বড় আপু মাহমুদা বেগম একজন কলেজের শিক্ষিকা হিসেবে উনি আমাদের যথাযথ সম্মান ও প্রশংসা করতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি। ফোন করে কখনো উনাকে আগে ছালাম দেয়া যায়নি, উনিই আগে আমাদের ছালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। সকল কাজে সব সময় তিনি ছিলেন ভীষণ রকমের ইতিবাচক; ত্বরিত সিদ্ধান্ত দিয়ে অতি দ্রুত তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করতেন।
শুধু আমার কাছে কেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ, চাকুরিজীবী, ঝালকাঠির সর্বস্তরের জনগণের কাছে তাঁর একটা প্রচণ্ড রকমের গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
সদা হাস্যময়, প্রাণচাঞ্চল্যে উৎফুল্ল, মেধাবী, প্রজ্ঞাবান, যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও অসীম ধীশক্তির অধিকারী সুদর্শন এবং ঘ্যামা এই মানুষটির জন্যে ঝালকাঠির সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রিয়জন হারানোর বিয়োগ ব্যাথায় হাহাকার করতে দেখেছি। সবার মুখে মুখে একই কথা ঝালকাঠিবাসী একজন ভাল ও দক্ষ জেলা প্রশাসককে হারালো; এ অভাব পূরন হবার নয়!
নিশ্চিত বিদায় ঘন্টা বেজেছে জেনেও অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে এই মানুষটিকে তাঁর কর্ম সম্পাদন করতে দেখে হতবাক হয়েছি। পদোন্নতি (যুগ্মসচিব) ও বদলি জনিত কারণে উনি যোগদান করতে যাচ্ছেন যদিও বর্তমান পদ অপেক্ষা একটা অধিকতর কম গুরুত্বপূর্ণ পদে, সেটার কারণেও তাঁকে এ নিয়ে কখনো বিচলিত হতে দেখিনি; তাতে বোঝা যায় উনি কতটা বড় মনের মানুষ!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সর্বদা সজাগ ছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সারথি। ২৪ ঘণ্টা ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার থেকে তথ্য নিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মোঃ জোহর আলী। তার কর্মের কারণেই স্মরণীয় এ বিদায়টি পেয়েছেন তিনি। ঝালকাঠি জেলার উন্নয়নের স্বার্থে সততা, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন।
মানুষ মাত্রেই চায় প্রিয়জনকে কাছে রাখতে বা প্রিয়জনের পাশে অবস্থান করতে; কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সেটা সব সময় হয়ে ওঠে না। তাই বিচ্ছেদ ব্যথা যত ব্যথাতুরই হোক না কেন একটা সময় প্রিয়জনকে বিদায় দিতে হয় এবং প্রিয়জন হতে বিদায় নিতে হয়। বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোঃ জোহর আলী মহোদয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থাও তথৈবচ!
তিন অক্ষরের বাংলা “বিদায়” শব্দটি বড্ড পীড়াদায়ক। তাই বিদায় শুনলেই বুকের মধ্যে কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে আর কেবলই মনে পড়ে বিশ্ব বরেণ্য বাঙালী কবি রবি ঠাকুরের যেতে নাহি দিব কবিতা কয়েকটি চরণ:
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন–“যেতে নাহি দিব’। হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।
প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
“দিব না দিব না যেতে’ ডাকিতে ডাকিতে
হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
“দিব না দিব না যেতে’– নাহি শুনে কেউ।
প্রিয় মহোদয়:
আসা যাওয়ার খেয়াতরীতে আমরা যাত্রী নিরবধি বৈ তো আর কিছু নেই। এমনি করে দৃশ্যমান পৃথিবীতে আসা যাওয়ার দোলাচলে দোল খেতে খেতে আমরা সবাই একদিন অচিনপুরের নিতাইগঞ্জে চলে যাব, যেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসে না।
মানুষ বাঁচে আশায়
মানুষ বাঁচে ভালবাসায়।
দিন যায় কথা থাকে,
মানুষ চলে যায়
রয়ে যায় তার কর্ম কথা আর আচরণ ও বিচরণের কথকতা; সেদিক দিয়ে আপনার মত সার্থক মানুষ খুব কমই আছে!
স্মৃতির সুধায় যে পাত্র আপনি ঝালকাঠিতে কানায় কানায় পূর্ণ করে গেলেন সেটার অনুরণন চলবে কাল থেকে কালান্তরে।
পরিশেষে দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের “বিদায় বেলায়” কবিতার কয়েকটি চরণধ্বনির আলোকপাত করতে চাইছি যা আপনার বিদায়ী মন ও মননের সাথে অনেক বেশি সংগতিপূর্ণ:
“তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,
ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,
হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
আজও তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
—————————-
—————————-
তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায়
কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়
আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-
পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!
কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো
মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,
ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।”
পরিশেষে পরম করুণাময় মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি আপনার আগামীদিনের চলার পথকে সুন্দর করে; আপনাকে অফুরান কর্মক্ষমতার অধিকারী করুন।
আপনার সাথে ঝালকাঠিতে অবস্থান কালীন স্মৃতি আমাদের সবার মনের মণিকোঠায় চির জাগরূক থাকুক এই প্রত্যাশা রইলো।
আপনার প্রতি অনেক অনেক শুভ কামনা, দোয়া ও ভালোবাসা রইলো।
কথা হবে নিরন্তর; দেখা হবে অনুক্ষণ, এই প্রত্যাশায় আল্লাহ্ হাফেজ!
✒️লেখকঃ- মুহাম্মাদ ইমাদুল হক (প্রিন্স)
ডেপুটি রেজিস্ট্রার
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল:-০১৭১১-১৯১৩৮৭
E-mail :- [email protected]