২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পটুয়াখালী পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে ৯০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

পটুয়াখালী প্রতিনিধি ::: ভুয়া টেন্ডার, একই কাজে ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প ও অতিরিক্ত দরে প্রাক্কলন তৈরিসহ বিভিন্ন ভাবে পৌরসভার ৯০ কোটি টাকা লুটের অভিযোগ উঠেছে পটুয়াখালী পৌর মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি মো. রেদোয়ান আহম্মেদ নামে একজন ঠিকাদার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে পৌর মেয়রের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।

এদিকে গত পাঁচ বছর ধরে পটুয়াখালী পৌরসভার প্রকৌশল শাখায় অধিকাংশ প্রকল্পে পদ্মা ব্যাংকের ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি ও পে-অর্ডার ব্যবহার করেছেন মেয়র ও তার ঘনিষ্ঠজনেরা। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পটুয়াখালী পদ্মা ব্যাংক শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেন, অফিসার নাইমুল ইসলাম ও নাজমুল হুদা সোহাগসহ ৬ কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুত করেছে পদ্মা ব্যাংক ।

অভিযোগে রেদোয়ান আহম্মেদ উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালে বাসস্ট্যান্ডের পাশে ও মেয়রের ব্যবসায়িক পাটনার মিজানুর রহমান স্বপন মৃধার বাড়ির সংলগ্ন খালে দুইটি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরে একই ব্রিজের নামে এলজিইডি থেকে পুনরায় টেন্ডার করা হয় মেয়রের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মহিউদ্দিনের নামে। এ টেন্ডারে কার্যাদেশ নিয়ে ৪ কোটি টাকা লোপাট করা হয়।

এদিকে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ পিপিআইডিপি/ডিআর প্যাকেজে একটি দরপত্র আহ্বান করেন এবং আইইউ আইডিপি-২/পটুয়া/পি-১০ প্যাকেজে ২০২০ সালে ১০ মে একই দরপত্র আহ্বান করে পৃথক দুটি প্যাকেজের কাজ অন্য প্রকল্প থেকে বাস্তবায়ন করে ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোপাট করে মেয়র ।

২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পৌর এলাকার তিতাস সিনেমা হল থেকে রুস্তুম মৃধার কালভার্ট পর্যন্ত সড়ক সংস্কারের দরপত্র আহ্বান করে পৌরসভা। এতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৬ কোটি টাকা। দুই মাস পরে ২৪ নভেম্বর একই সড়ক আবার সংস্কারের নামে দ্বিতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়। একই সড়কের নামে পৃথক ৪টি প্রকল্প দেখিয়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকা লোপাট করেন মেয়র।

২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর পিপিআইডিপি/আরডি/২০১৯-২০২০/১২ এর আওতায় ডিসির বাসভবন থেকে কলাতলা-যুব সংসদ হয়ে বাবরি মসজিদ দিয়ে হেতালিয়া বাধঘাট পর্যন্ত সড়ক সংস্কারের দরপত্র আহ্বান করে পৌরসভা। তবে পিপিআইডিপি/আরডি প্রকল্পের আওতায় একই বছরের ২৩ এপ্রিল একই সড়কে ইউনি ব্লক সংস্কার দেখিয়ে বরাদ্দের টাকা লোপাট করেন মেয়র। পরে দৃষ্টিনন্দন শহর গড়ার নামে নির্দিষ্ট সড়কে গাছ রোপণ করে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়েছেন মেয়র।

পৌর এলাকার গরুর বাঁধ সংলগ্ন পুকুর, কলের পুকুর, জেলা কারাগার পুকুর, সরকারি কলেজের পুকুর এবং সার্কিট হাউজ সংলগ্ন পুকুর বা ডিসির বাসভন সংলগ্ন পুকুর খনন করেছেন এলজিইডি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে ২০২১ সালের ২ মার্চ প্যাকেজ নং-পিপি আইডিপি/ডিইএইউ/২০১৯-২০২০/১৪ এবং পিপিআইডিপি/পিইএইউ/২০২০-২০২১/১৫ প্যাকেজের আওতায় পৌরসভা থেকে পৃথক দরপত্র আহ্বান করে ১৮ কোটি টাকা লোপাট করেন মেয়র।

ঝাউতলা সংলগ্ন পুকুর পাড়ে ৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন মেয়র। অথচ এলজিইডি, গণপূর্ত বিভাগ জানান সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা ব্যয়ে এরকম শহীদ মিনার করা সম্ভব।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, বিগত ৫ বছর পৌরসভার সকল উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার ছিলেন মেয়র মহিউদ্দিন ও তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ, মিজানুর রহমান স্বপন মৃধা, অভি সিকদার, বাপ্পি মিয়া, কলাতলার জাহাঙ্গীরসহ মেয়রের কাছের লোকজন। বাস্তবায়িত সকল প্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রীও সরবরাহ করেন মেয়রের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান থেকে। এছাড়াও দ্বিগুণ দামে স্টেশনারী, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতেন কাজী নাসরু তালুকদার, ফরহাদ জামান বাদল এবং মেয়রের কাছের লোকজন। অভিযোগ রয়েছে, পরিচ্ছন্ন কর্মীর ব্যবহৃত অ্যাপ্রনের বাজার মূল্য ৩০০ টাকা হলেও প্রতিটি এপ্রোর দাম ধরা হয়েছে ৩ হাজার টাকা করে। এসব খাত থেকে গত ৫ বছরে কোটি টাকা হাতিয়েছেন মেয়র ও তার কাছের লোকজন। শহরের সব সড়কের বাতি তিনগুণ দামে সরবরাহ করেছেন মেয়রের বন্ধু জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাড. হাফিজুর রহমান। পৌর এলাকার সকল পানির লাইন সংযোগ দিতেন হাফিজুর রহমানের বড় ভাই বাবু এবং পানির মিটার দিতেন কাজী নাসরু তালুকদার। ৫ বছরে পৌরসভার সকল কার্যক্রম ছিল মেয়রের বলয়ে। যে কারণে মহিউদ্দিন আহম্মেদ ক্ষমতায় বসে পৌরসভার তালিকাভুক্ত অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের নবায়ন দেননি।

পৌরসভা মেয়র, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ মোট ৫টি সচল যানবাহন থাকলেও ভুয়া বিল ভাউচার করে রাজস্ব খাত থেকে আড়াই কোটি টাকা লোপাট করেন চালক মাসুদ ও সিদ্দিকুর রহমান।

প্রভাব খাটিয়ে পটুয়াখালী এলজিইডি থেকে নেওয়া প্রকল্পগুলোতে বিশেষ কৌশলে বাজার দরের থেকে দ্বিগুণ মূল্য নির্ধারণ করে একাধিক প্রকল্প নেন মেয়র মহিউদ্দিন ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাফিজুর রহমান। ইতোপূর্বে মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ ও হাফিজুর রহমানের প্রভাব খাটানো টেন্ডার ও দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়ে বিভাগীয় মামলার শিকার হয়েছে এলজিইডির তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার ও জিএম শাহাবুদ্দিনসহ একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এ বিষয়ে জানতে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জসীম উদ্দিন আরজুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভারতে থাকার কথা জানান।

এ বিষয়ে জানতে পটুয়াখালী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড. হাফিজুর রহমানের (হাফিজ) মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।

অভিযোগের বিষয়ে মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ জানান, ‘কেনো নেগেটিভ নিউজ করবেন নাকি? সবি তো নেগেটিভ করেন। যা পারেন লেখেন। প্রয়োজনে বেশি বেশি করে লেখেন।’

পদ্মা ব্যাংক থেকে চাকুরিচ্যুত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিষয়ে জানতে পটুয়াখালী পদ্মা ব্যাংক শাখায় গিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের বর্তমান ম্যানেজার মো. শামীম বলেন, আমি পটুয়াখালী শাখায় এসেছি ৬ মাস হয়েছে। এর আগে কি হয়েছে বা কে চাকরি করেছে সেই তথ্য আপনাকে দিতে পারব না। তবে এই বিষয়টি আমি লোকমুখে শুনেছি। কতটুকু সত্য তা জানি না। পরে তিনি ঢাকা অফিস থেকে তথ্য নেওয়ার পরামর্শ দেন। পদ্মা ব্যাংকের এইচআর তমাল কুমার রনি বলেন, এই তথ্য দেবে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট থেকে, এজন্য আপনাদেরকে আবেদন করতে হবে।

পটুয়াখালী পদ্মা ব্যাংক শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয় পটুয়াখালীর দুদকের উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, আমরা এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ঢাকার প্রধান অফিসে পাঠানো হবে। তারা অনুমতি দিলে এটা নিয়ে আমরা কাজ করব। তবে ঢাকা দুদকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভিযোগটি ঢালাও নয়, দুর্নীতির স্পষ্ট তথ্যও রয়েছে এখানে। অভিযোগটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কমিশন অনুমোদন দিলে দুদকের অনুসন্ধানী টিম মাঠে নামবে।

অভিযোগকারী মো. রেদোয়ান আহম্মেদ বলেন, মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ দুর্নীতি করে শতকোটি টাকা লোপাট করেছেন। অভিযোগের সঙ্গে সব কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে। মেয়র ও তার ভাই পদ্মা ব্যাংকের ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি ও পে-অর্ডার ব্যবহার করার কারণে পটুয়াখালী পদ্মা ব্যাংক শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক আলমগীরসহ ৬ জনের চাকরি চলে গেছে।

সর্বশেষ