নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
শারমিন বেগম (২০) সপ্তম শ্রেণী পাস মাদ্রাসা ছাত্রী। সে উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়ন ৮নং ওয়ার্ডের রফিকুল ইসলামের মেয়ে। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার না হতেই ২০২০ সালে ২৭ জানুয়ারিতে তার বিয়ে হয় হাজারীগঞ্জ ৫ নং ওয়ার্ডের শফিউল্লাহর ছেলে মিরাজ(২৭) এর সঙ্গে। ইসলামী শরীয়া মোতাবেক বিয়ের পর সামাজিকভাবে ধুমধাম করে আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্বর্ণালঙ্কার ও উপহার সামগ্রী সহ প্রায় ২লাখ ৮৫ হাজার টাকার মালামাল গ্রহণ পূর্বক বাবা মা মেয়ে শারমিনকে তুলে দেয় মিরাজের হাতে। মেয়ের সুখের আশায় বুক বেঁধে তার বাবা-মা যখন যা খুশি তাই দিতেন মিরাজকে। তবে এতো সুখ শারমিনের কপালে আর সইল না। কথায় আছে “অতি লোভে তাঁতি নষ্ট”। মিরাজ তারই উদাহরণ। যৌতুকের দাবিতে একের পর এক নির্যাতনের শিকার শারমিন। দাবি অনুযায়ী একবার শ্বশুর পক্ষ ১ লক্ষ টাকায় একটি গাড়ি কেনার জন্য মেয়ের সুখের চিন্তা করে তুলে দেয় জামাই মিরাজের হাতে। এতেও তার মন মজেনি। আরও ২০ হাজার টাকা দেন তাকে।তাতেও পেট ভরেনি তার।
বিয়ের এক বছরের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত তার সারা অঙ্গ। এমন নির্যাতন শুধু মিরাজই করেনি। তার বাবা-মা, ভাই-বোন, মিলে সংসারের বিভিন্ন ছুতো ধরে এই নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে কয়েকবার সালিশ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে মিরাজের পরিবার দোষ স্বীকার করায় শারমিনকে আবারো ওই ঘরে তুলে দেয়।
শেষমেষ গত ২২ জানুয়ারি ২০২০ ইং তারিখে দুপুরে মিরাজের বসত ঘরে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ দেবর, মিলে এক লক্ষ টাকা যৌতুক দাবি করে চাপ দেয়। এতে অস্বীকৃতি জানালে গৃহবধূ শারমিনকে সবাই মিলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বেদম মারধর করে। এতে শারমিন অজ্ঞান হয়ে পড়লে অচেতন অবস্থায় শারমিনকে ঘর থেকে বের করে দেয় তারা।
সংবাদ পেয়ে তার বাবা রফিকুল ইসলাম স্থানীয়দের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে চরফ্যাশন হাসপাতালে ভর্তি করে। যার ভর্তি রেজিস্ট্রেশন নং ১৮৫৩/৬১। যা আদালতের মামলার বিবরণীতে উল্লেখ আছে।
বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করার চেষ্টা করলে ব্যর্থ হয়ে শশীভূষণ থানায় মামলা করতে যায়। থানা পুলিশ মামলা নেয়নি।
নিরুপায় হয়ে গত ২৩ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে ভোলা জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত গৃহবধূ শারমিন বাদী হয়ে স্বামী মিরাজ সহ ৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। যার কমপ্লেইন পিটিশন নং ৬১/২০২১ ইং। বিজ্ঞ আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য চেয়ারম্যান বাজার অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেয় আদালত। নির্দেশনা পেয়ে অধ্যক্ষ মোঃ শাহাবুদ্দিন সাহেব গত ১২ফেব্রুয়ারি ২০২১ইং তারিখে বিবাদীদের বসত বাড়ি গিয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বার, সাংবাদিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করেন। এ সময় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে হাজারীগঞ্জ ৫ নং ওয়ার্ডের মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে আবুল কালাম, আবুল খায়ের পাটোয়ারীর ছেলে সুফিয়ান পাটোয়ারী, সুলতান আহমেদের ছেলে শফিকুল ইসলাম সহ কয়েকজন জানান, শারমিনের বিয়ের এক বছরের মধ্যে তাদের মধ্যে পারিবারিক কলহ লেগেই আছে। এ নিয়ে তারা কয়েকবার সালিশ করছে। তাতেও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। কারণ হিসেবে জানতে চাইলে তারা জানান, মিরাজের বিয়ের পূর্ব থেকেই ৫ নং ওয়ার্ডের শাহজাহান মৃধার নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে নুপুর (১৮)এর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল মিরাজের। মিরাজ বিয়ে করে শারমিনকে আর নুপুরকে বিয়ে দেয় বোরহানউদ্দিন উপজেলায় কোন বাড়িতে। তবুও থেমে থাকেনি মিরাজ নুপুরের পরকীয়া প্রেম। বিয়ের পর মিরাজ নুপুরের প্রেম আরো গভীর হয়। প্রেমের সূত্র ধরে তাদের দুজনের মোবাইলে কথোপকথন হত হরদমে। তা আবার মোবাইলে রেকর্ডও হয়ে যায়। এ রেকর্ড এর সূত্র ধরে মিরাজের সাথে স্ত্রীর শারমিনের প্রায়ই নির্যাতন ও ঝগড়া ঝাটি লেগেই থাকত। ঝগড়ার এক পর্যায়ে শশুর শাশুড়ি কে নিয়ে স্থানীয়ভাবে কয়েকবার সালিশিও হয়। সালিশি হলেও মিরাজ ও তার বাবা-মা একপর্যায়ে ওই পরকীয়া প্রেমিক হিসেবে ওই নুপুরকে ঘরে তোলার জন্য জনসম্মুখে প্রচার করে। এমন ঘটনার পরও মেয়ে শারমিনকে স্থানীয় সালিশরা মিরাজের ঘরে তোলার জন্য অনুরোধ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মিরাজ তার মাকে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বেদম মারধর করে। মারধরের ঘটনায়ও স্থানীয়রা মীমাংসা করে দেয় বলে সালিশিরা জানায়, এসব ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দিন মিরাজের বাবা মাকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানান, আমার ছেলে আমাকে মারছে তাতে দোষের কী। এতে অন্যের সমস্যা কোথায়। এসময় স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
নির্যাতিত গৃহবধূ শারমিন জানান, আদালতে মামলা করায় মামলার ৫ নং আসামি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানাধিন গোছরা গ্রামের মোসলেম হাওলাদারের ছেলে বেল্লাল (৩০)মোবাইলে হুমকি দিয়ে আসছে। মামলা করে শারমিন ও তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এদিকে মিরাজের বাবা জানান, মামলা কথা শুনে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি /২১ ছেলে বউ শারমিনকে তালাক দেয়া হয়েছে, এবং তা নোটারিও করা হয়েছে।
এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দিন জানান, মামলার বিpবরণ অনুযায়ী তদন্ত করা হয়েছে। স্থানীয়দের উপস্থিতিতে আরও কিছু নতুন তথ্য পেয়েছি। তবে পরকীয়া প্রেমিকা নুপুরের কারণে এ সংসার ভেঙেছে বলে মনে করছি। তবে এসব ঘটনার শাস্তি হওয়া উচিত।