১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
বিমানবন্দরে গৃহবধূকে মারধর।। বঙ্গোপসাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা: চরম দুশ্চিন্তায় জেলেরা ! মায়ের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজের অভিযোগ মেয়ের, শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন উজিরপুরে তাবিজ দেয়ায় ইমামকে বহিষ্কার, খুলে নেওয়া হলো দানের মালামাল বাউফলে বজ্রপাতে শ্রেণি কক্ষে সংজ্ঞা হারিয়ে হাসপাতালে দুই শিক্ষার্থী চরফ্যাশনে বিদ্যুৎস্পৃ*ষ্টে প্রাণ গেল শিশুর দশমিনায় মোবাইল না দিয়ে মায়ের বকাঝকা, এসএসসি পাস শিক্ষার্থীর আ*ত্মহ*ত্যা দুমকিতে কাওসার আমিনের উঠােন বৈঠকে হাজার হাজার জনতার ঢল গলাচিপা উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ১৫ জন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকবেন হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৩ বছর, পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

মোহাম্মদ খায়রুল বশার :

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের এক দশমাংশ আয়তন জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। রাংগামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। এ তিনিটি জেলার মোট আয়তন ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী এ অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ১৫,৮৭,০০০ জন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জাতিসত্তাসমূহের অধিবাসীদের মধ্যে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চংগ্যা, ¤্রাে, লুসাই, বোম, পাংখো, থুমি, চাক, খেয়াং, প্রভৃুত উপজাতি রয়েছে। অ-উপজাতীয়দের মধ্যে ৪৮ ভাগ মুসলমান এবং বাকীরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের। এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তা ও অ-উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ ভাষা, সাংস্কৃতি, ধর্ম ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সকীয়তা বজায় রেখে যুগ যুগ ধরে একে অপরের পাশাপাশি বসবাস করে আসছে।

১৯৯৬ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য সমস্যাকে স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যবৃন্দ অন্তর্ভুক্ত হন। তৎকালীন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ এবং বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ্’র নেতৃত্বে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদসদের মধ্যে ছিলেন, এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আতাউর রহমান খান কায়ছার, কল্প রঞ্জন চাকমা, দীপংকর তালুকদার, বীর বাহাদুর, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, জয়নুল আবদীন ফারুক, এডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া এবং মোঃ শাহজাহান চৌধুরী। পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র গ্রুপ শান্তি বাহিনী নামে বেশকিছু সংগঠন থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ছিল অন্যতম। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা, সুধাসিদ্ধু খীশা, রূপায়ন দেওয়ান ও গৌতম চাকমা ছিলেন জনসংহতি সমিতির অন্যতম।

আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই পার্বত্য অঞ্চলের বিরাজমান সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তিনি জাতীয় কমিটির সদস্যদের নিয়ে একাধিকবার খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিদর্শন করেন। জাতীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ পার্বত্য অঞ্চলের মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার স্থায়ী সমাধানের জন্য জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউস, খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউস এবং ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বেশ কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হলেও বিএনপি’র দুজন সংসদ সদস্য কোন সভায় যোগ দেননি। এক পর্যায়ে জাতীয় কমিটি ও জনসংহতি সমিতি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে একমত পোষন করেন। অতঃপর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’ এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পুর্ণ ও অবিচল আনগত্য রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও অর্থিৈনতক অধিকার এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করাসহ বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি নিঃসন্দেহে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক। সংঘাত, সংঘর্ষ, বিদ্বেষ বিভেদ, হানাহানি রক্তক্ষয় পেছনে ফেলে পার্বত্য অঞ্চল জুড়ে পাহাড়ী বাঙালীদের মধ্যে স্থায়ী শান্তি, সৌহাদ্য ও সম্প্রীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার, বিপুল পরিমান বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষন, পর্যটন কেন্দ্র নির্মানসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনায় এ অঞ্চল আজ ভরপুর। দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এক সহিংস অবস্থা বিরাজ করছিল। পাহাড়ী বাঙ্গালী নিরাপত্তা রক্ষী নির্বিশেষে বহুজনের প্রাণহানি ঘটেছে, বিনস্ট হয়েছে অনেক মূল্যবান সম্পদ। বিঘিœত হয়েছে উন্নয়ন প্রক্রিয়া। দেশের এক দশমাংশ ভৌগলিক এলাকা হয়ে পড়েছিল অভ্যন্তরীনভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন।

তৃতীয় কোন পক্ষের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই এই জটিল ও দুঃসাধ্য কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয়েছে। যে কারণে দেশ বিদেশে পার্বত্য শান্তিচুক্তি এত বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এই চুক্তি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ সরকারের একটি সাহসী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, যার রূপকার সাবেক চীফ হুইপ বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদা) আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ্ এমপি।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত চুক্তি ৪ (চার) খন্ডে বিভক্ত। ‘ক’ খন্ডে ৪ (চার) টি, ‘খ’ খন্ডে ৩৫ (পয়ত্রিশ) টি, ‘গ’ খন্ডে ১৪ (চৌদ্দ) টি এবং ‘ঘ’ খন্ডে ১৯ (উনিশ) টি সর্বমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যমতে ৭২টি ধারার ৪৮টি ধারা সম্পুর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এই চুক্তির ফলে ১৫/০৭/১৯৯৮ তারিখ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে ব্যপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং এ অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক অগ্রগতি, অবকাঠামো সহ অন্যান্য খাতসমূহ সুষমভাবে উন্নয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রাণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সৌহার্য্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ বিরাজ করছে।

শান্তিচুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে মোবাইল সংযোগ চালু করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্র/ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এক হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দের আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় ১৯টি এডিপিভুক্ত প্রকল্প এবং উন্নয়ন সহায়তার আওতায় দুই হাজার একশতটি ছোট ছোট স্কীম গ্রহণ করা হয়েছে। টিআর খাতে ৮০ হাজার মেট্্িরক টন খাদ্যশস্য এবং জিআর খাতে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় মিশ্র ফল চাষ প্রকল্পের আওতায় ৮৪০টি বাগান সৃজন করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে সড়ক পাকাকরণ, এইচবিবি রাস্তা উন্নয়ন, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, বিহার নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চমূল্যের মসলা চাষ প্রকল্পের আওতায় ৮০০টি বাগান সৃজন করা হয়েছে। সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে নলকূপ, উৎপাদক নলকুপ, ডিএসপি নলকুপ, সাবমারসিবল পাম্প, ডিপসেট পাম্প, স্থাপন করা হয়েছে। অস্বচ্ছল ও প্রান্তিক পরিবারের নারী উন্নয়নে গাভী পালন প্রকল্পের আওতায় গাভী সরবরাহ করা হয়েছে। ঢাকার বেইলী রোডে ‘শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স’ নির্মান করা হয়েছে। ২৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশের ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক ও সুদুরপ্রসারী সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার লাভ।

শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে আজ শান্তির সুবাতাস বইছে এবং উৎসবমূখর পরিবেশে শান্তিচুক্তি দিবস পালিত হচ্ছে।

সর্বশেষ