১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সংবাদ শিরোনাম

বরিশালে ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত পথশিশুরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

নিজস্ব প্রতিবেদক ::: বরিশাল নগরের লঞ্চঘাট ট্রার্মিনালের ভেতরে প্রবেশ করে চোখে পড়লো চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপর বসে একটি শিশু কিযেন খাচ্ছে। দূর থেকেই কৌতূহলী চোখ দেখতে থাকলাম তাকে। বোঝা গেল, একটি পলিথিনে করে কিছু নিয়ে শিশুটি খাচ্ছে। হঠাৎ তার সামনে গিয়ে দেখতে পারলাম শিশুটি মুখের সামনে পলিথিন নিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তখনেই স্পষ্ট হয় বিষয়টি। শিশুটি সর্বনাশা মাদক ‘ড্যান্ডি’ গ্রহণ করছে। ৭ থেকে ৮ বছর বয়সের এই শিশুটি তলিয়ে যাচ্ছে মাদকের করালগ্রাসে। যেই মোবাইলটা হাতে নিলাম, অমনি মুখ থেকে পলিথিনটা সড়ানোর চেষ্টা করে শিশুটি।

কথা বলার জন্য অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর নাম বলেন সোহেল। পরিচয় দিলো তিনি ঢাকা থেকে আসছে। কেন এই ড্যান্ডি নিচ্ছো, জানতে চাইলে শিশুটি হেসে ওঠে। মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন, ‘মোর বাপ-মা নাই, এল্লিগাইতো ড্যান্ডি খাই।

শুধু পথশিশুরাই নয়, ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত হচ্ছে সাধারণ পরিবার ও শ্রমজীবী শিশু-কিশোররা। এর প্রধান কারণ ‘ডেন্ডি’ গামের সহজলভ্যতা। ড্যান্ডি গাম বিক্রিতে তেমন কোন নীতিমালা না থাকায় হাতের নাগালেই মিলছে এ নেশা দ্রব্য। এমনকি ড্যান্ডি নেশা থেকে পথশিশু-কিশোরদের রক্ষায় দেখা যাচ্ছে না প্রশাসনেরও জোড়ালো কোনো ভুমিকাও। ফলে ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত শিশু-কিশোরের সংখ্যাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরাই এক সময় ঝুকছে গাঁজা, মদ, ফেন্সিডিল ও ইয়াবার দিকে। আর নেশার টাকার যোগান দিতে তারা জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মত নানা অপরাধে।

জানা গেছে, ড্যান্ডি এক ধরনের গাম। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে গ্যারেজ বা ওয়ার্কশপে। তবে এটি জুতা তৈরীর প্রধান উপকরণ। এগুলো পাওয়ার সহজ উপায় নগরীর বিভিন্ন যানবাহনের পার্স এবং হার্ডওয়ারের দোকানে। কিন্তু ‘ড্যান্ডি’ নামক এই গামই ব্যবহার হচ্ছে নেশার কাজে। সল্প খরচে পাওয়া ‘ড্যান্ডি গাম’ পলিথিনে ঢেলে একটু ঝাঁকুনি নিয়ে তার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে গন্ধ শুঁকে নেশা করা হচ্ছে। ‘ড্যান্ডি গামে তীব্র গন্ধ না থাকায় শিশু-কিশোররা যে কোন জায়গায় দাড়িয়েই গ্রহন করছে এই নেশা। নগরীর লঞ্চঘাট, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, বঙ্গবন্ধু উদ্যান, রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড, কাঠালতলা, নথুল্লাবাদ, আমতলা পানির ট্যাংকসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে ড্যান্ডি সেবন করে এ সব শিশু-কিশোররা।

মাদকাসক্ত এসব শিশুদের চিকিৎসার জন্য অর্থের বিনিময়ে বেসরকারিভাবে বরিশালে ৫০ আসনের ৫টি ও ১০ আসনের ১টি নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও সরকারি কোন নিরাময় কেন্দ্র নেই।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগে প্রায় ৯ হাজার ৭৭১ জন পথশিশু বা ছিন্নমূল শিশু রয়েছে। যারা অধিকাংশই মাদকাসক্ত। জুতা কিংবা ফোমে ব্যবহৃত সলিউশন (আঠা) পলিথিনে ভরে কিছুক্ষণ পরপর মুখের সামনে নিয়ে শ্বাস টেনে নেশা করতে দেখা যায় তাদের। এতে মাথা ঝিম ঝিম করে। অর্থাভাবে খেয়ে না খেয়ে তাদের রাত কাটে পথে-ঘাটে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে বছরের বিভিন্ন দিবসগুলোতে এসব শিশুদের নিয়ে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেলেও বছরের বাকি সময় তাদের পাশে কাউকে দেখা যায় না। ফলে অভিভাবকহীন এসব শিশুর পথচলা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোপনে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের। আবার জোর করেও তাদের এসব ক্রিয়াকলাপে নিয়োগ করা হচ্ছে। ড্যান্ডির টাকা জোগার করতে অনেকে আছে ভিক্ষা ও চুরির সঙ্গে জড়িত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা যা তাদের অধিকার।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, শিশুদের যে কোনো ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। শিশুদের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অধিকার জন্মগত। তারপরও এসব শিশুরা থেকে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে। ভাগ্য বিড়ম্বিত পথশিশুদের জন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সংগঠন যে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বরিশালে অভিভাবকহীন, হারিয়ে যাওয়া, এতিম-মিসকিন শিশুদের জন্য শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং সরকারি শিশু পরিবার বালিকা নামে মোট তিনটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে মোট ৪০০ আসন থাকলেও সেখানে মাদকাসক্ত ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মোস্তফা কামাল এর কাছে জানতে চেয়েছি ড্যান্ডি নেশার ভয়াবহতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ড্যান্ডি’ অন্যান্য নেশার থেকেও খুব ভয়াবহ। এগুলো গ্রহনের ফলে মানব দেশের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ব্রেন, কিডনি, লিভার ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং ক্ষুদা মন্দাসহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়। তিনি বলেন, ‘মুলত ছিন্নমুল শিশু এবং বিভিন্ন কল কারখানার শিশুরাই এই নেশার প্রতি বেশি আসক্ত। এজন্য তাদের কাউন্সিলিং করা উচিৎ। যেসব শিশুর বাবা-মা রয়েছে তারা তাদের সন্তান কি করে কোথায় যায়, কি খায় সে দিকে নজর রাখবে। ড্যান্ডি নেশা গ্রহন করা শিশু-কিশোরদের এ নেশার খারাপ দিক গুলো ভালোভাবে বোঝাতে হবে। পাশাপাশি এ নেশা নিয়ন্ত্রন করতে প্রথমত যারা শিশুদের কাছে ড্যান্ডি গাম বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিৎ।

বরিশাল উপ-প্রকল্প পরিচালক শুভঙ্কর ভট্টাচার্য্য জানান, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রায় সকল শিশুকে ৩ মাস ও ৬ মাস মেয়াদে বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বর্নিভর করে গড়ে তুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিবাসী শিশুর প্রশিক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- কম্পিউটার, মোবাইল সার্ভিসিং, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, টেইলারিং, ব্লক-বাটিকসহ পারিবারিক সবজি চাষসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, সমাজের সকল স্তরের বিশেষ করে সচেতন অভিভাবকদের আরো সচেতন হয়ে সকলের সন্তানকে লালন-পালন করার পাশাপাশি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনার। একজন শিক্ষিত “মা” করেন একটি শিক্ষিত পরিবেশ উপহার দিতে পারেন। কন্যা সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে মায়ের পাশাপাশি বাবাদের ভূমিকা রাখতে হবে। একক প্রচেষ্টায় কখনোই সমাজ থেকে এই নেশা দ্রব্য ব্যাধি নির্মূল করা সম্ভব নয়। চাই সামাজিক সচেতনা চাই সবার সমন্বয় সাহায্য সহানুভুতির হাত দুটি বাড়িয়ে দিলে আমরা সকলে প্রত্যাকে সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব কায়িক পরিশ্রম ও লেখনি শক্তির মাধ্যমে সমাজে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে যতটা সম্ভব। সুন্দর শিশুটি একটি সুন্দার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সুত্রে জানান, মাদকাসক্ত শিশুদের মামলা দেওয়া যায় না-এটা আমাদের জন্য একটা প্রতিবন্ধকতা। আবার বরিশালে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রও নেই যেখানে তাদের চিকিৎসক করা হবে। এ সব শিশুদের চিকিৎসার জন্য সরকারি নিরাময় কেন্দ্র চালু করার আশ্বাস দেন তিনি।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আল মামুন তালুকদার বলেন, মাদকাসক্ত ছিন্নমূল শিশুদের জন্য তেমন কিছু করার নেই। কারণ সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় এই ধরনের কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তবে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। এছাড়া আমাদের শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রেও ব্যাপক আসন সংকট। শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে বর্তমানে সর্বমোট ১৮৫ জন বালক ও বালিকাকে উল্লেখযোগ্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এসব ঝুঁকিতে থাকা অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত পথ শিশুদের আশ্রয়, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, মনোসামাজিক সহায়তা, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নগরীর রূপাতলী বাসস্ট্যন্ড সংলগ্ন এই কেন্দ্র এখন সকলের আস্থার স্থল।

এ বিষয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, শিশু-কিশোরদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও উন্নয়নে দেশের ৬টি বিভাগে ১৪টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মাধ্যমে পথশিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসব সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত, পথ শিশুরা আশ্রয় লাভ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোয় আলোকিত করে জীবনকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের পাশে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

সর্বশেষ