শাকিব বিপ্লব ::
হিন্দু মতালম্বী দ্ইু ব্যাক্তি করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর পর তাদের দাহ করা নিয়ে সময়ক্ষেপণের কারনে গতকাল শনিবার দুপুরের নিহতের পরিবারদের উত্তাপে বরিশাল মহাশ্মশান খবরের শিরোনাম হয়। একজন মৃত নরসুন্দরের দাহ করতে শ্মশান কতৃপক্ষের বাধা দেয়ার অভিযোগ সম্বলিত এই খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশের পর তা ভাইরাল হয়ে যায়। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দৌড়-ঝাপে ঘটনাস্থল পর্যন্ত পৌঁছে সুরাহা টানায় হঠাৎ করে বরিশালে অনেক বিষয় ছাপিয়ে গিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় মহাশ্মশানের এই খবর। জানা গেছে, বৃহৎ এই শ্মশান প্রতিষ্ঠার পর এধরনের বিষয় নিয়ে এটাই প্রথম কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলো। কিন্তু নেপথ্যের আসল খবর কি তা খবরের পেছনেই রয়ে যায়। পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে, করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর কিছু সময়ের ব্যাবধানে বরিশালের বহিরাগত দুইব্যাক্তির লাশ সৎকারের জন্য নিয়ে আসা হলে মহাশ্মশান কতৃপক্ষ জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুসরন করতে গেলে জটলা পাকিয়ে ফেলে মৃত নিতাই চন্দ্র শীলের পরিবার। নেপথ্যে থেকে শ্মশান কমিটির বিরোধী পক্ষ তাদের স্বার্থগত কারনে বিষয়টি আরো ঘোলাটে করে তোলে।
অভিযোগ ছিল, শ্মশান কতৃপক্ষ ইচ্ছাকৃত নিতাই চন্দ্র শীলের দাহকার্যে বাধাদান এবং তার পরিবারের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তথ্যানুসন্ধানে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে এ অভিযোগ সঠিক নয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুপুর ১২ টার দিকে মুলাদী উপজেলার স্বপন মজুমদার ও পড়ন্ত বিকেলে বাকেরগঞ্জের কলসকাঠি গ্রামের নিতাই চন্দ্র শীলের মৃতদেহ বরিশাল মহাশ্মশানে পর্যায়ক্রমে নিয়ে আসা হয়। নিশ্চিত হওয়া গেছে, উভয়ই শেবাচিম হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা যায়। তারা ভর্তির প্রাক্কালে বরিশাল নয়, আদি বাড়ি ঐ দুই উপজেলায় তাদের নাম-ঠিকানা নথিভুক্ত করে।
সেখানেই ঘটে বিপত্তি। জেলা প্রশাসক অজিউর রহমানের নির্দেশনা রয়েছে, বহিরাগত কোনো ব্যাক্তিকে মহাশ্মশানে সৎকার করা যাবেনা, ইতিপূর্বে এই মর্মে চিঠি দেয়া হয়েছিলো, সেই সূত্রে এই নিয়মের কথা তুলে ধরে শ্মশান কমিটির সাধারন সম্পাদক তমাল মালাকার বিষয়টি বিবেচনা করে সৎকারে সময় চেয়ে তাদের অপেক্ষায় থাকার অনুরোধ জানায়। মুলাদীর স্বপন মজুমদারের পরিবার আইনগত বিষয়টি মেনে নিলেও নিতাই চন্দ্র শীল’র পরিবার বেঁকে বসে এবং জোরপূর্বক শ্মশানের ভেতরে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করে। করোনা আক্রান্ত রোগী হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি এধরনের মৃত ব্যাক্তিদের সৎকার্য সম্পাদনে তিন জন নিয়োজত ডোম রাজু, বাদল ও মুন্না অস্বীকৃতি জানায়।
উত্তপ্ত পরিস্থিতির অবতারনায় লোকে লোকারণ্য এ খবরে শ্মশান কমিটির অপর তিন নেতা বিপ্লব সিংহ দত্ত, শশাঙ্ক সেন গুপ্ত ও বিপ্লব রায় ছুটে এসে তমাল মালাকারের সাথে একমত হন যে, লাশ দাহ করা যাবে, তবে জেলা প্রশাসকের অনুমতি সাপেক্ষে। একপর্যায়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চুপিসারে দাহকার্য সম্পাদনে সম্মতি দেয়ার শর্তে লাশ শ্মশানের বাইরে এম্বুলেন্স এর ভিতর রাখার জন্য উভয় পরিবারকে অনুরোধ রাখা হয়। কারন হিসেবে শ্মশান কমিটি নেতৃবৃন্দের ভাষ্য হচ্ছে, এই সময় আরও দুই ব্যাক্তির দাহকাজ চলছিলো, যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে । পাশাপাশি করোনা আক্রান্তে মৃতদের সৎকারে সরকারী নির্দেশনা অনুসরন করার কার্যাদি পালনে সময় লাগবে। সুতরাং করোনায় মৃত লাশ সুরক্ষায় এম্বুলেন্সের ভিতরে রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়। এছাড়া এধরনের মৃত ব্যাক্তির কারনে আশপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার বিষয়টিও বিবেচনায় আনা হয়েছিলো।
সূত্রের দাবী, শ্মশান কতৃপক্ষের এরূপ ব্যাখ্যা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিতাই চন্দ্র শীল’র লাশ তার পরিবার শ্মশানের ভেতরে পকেট গেট দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেস্টা করলে বাধা দেয়ায় সেখানে উত্তপ্তকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অবশ্য এরপরেই দুই পক্ষ দাহ করার নিয়ম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার প্রেক্ষাপটে নরসুন্দর কল্যাণ সমিতি নিতাই চন্দ্র শীলের পরিবারের সমর্থনে এগিয়ে এলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। জানা গেছে, নিতাই চন্দ্র শীল বাকেরগঞ্জের বাসিন্দা কিন্তু কর্মসূত্রে বরিশালে বসবাস করতেন। নগরীর চাঁদমারী খেয়াঘাট এলাকায় নিখিল হেয়ার ড্রেসারের মালিক পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যাক্তি বুকে ব্যাথা ও শ্বাস কষ্ট নিয়ে গত শনিবার সকালে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তির পর ১২ টার দিকে মারা যান।
একই দিন কিছু সময়ের ব্যাবধানে মুলাদীর স্বপন মজুমদারেরও মৃত্যু ঘটে। এই পরিবার মুলাদীতে তাদের লাশ দাহ করতে পারবেনা করোনা রোগী হওয়ায়, এমন সতর্কবার্তা পেয়ে বরিশালে সৎকার্য করার সিদ্ধান্ত নিলে তাদের বিষয়টি শ্মশান কমিটি মানবিক বিবেচনায় আমলে নিলে তারা অপেক্ষায় নির্শ্চুপ থাকেন।
শ্মশান কমিটির নেতৃবৃন্দের ভাষ্য ছিলো, শুক্রবার রাতে স্ট্রোকে মৃত্যু শহরের আবহাওয়া অফিস সংলগ্ন কলোনীর বাসিন্দা স্বপন দাস ও কাটপট্টি মোনালিসা মার্কেটের ব্যবসাযী কালা কর্মকারের সৎকার চলছে যা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করার অনুরোধ রাখা হয়েছিল।
কিন্তু নিতাই চন্দ্র শীলের লাশ এম্বুলেন্স থেকে বের করে শ্মশান সম্মুখে সড়কধারে রেখে একটি আন্দোলনময় পরিস্থিতির চেষ্টা চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা এমনটি দাবী করেছে। বিশেষ করে নরসুন্দর কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দকে প্রাধান্য না দেওয়ায় এই উত্ত্প্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে এই খবর মিডিয়া অঙ্গনে পৌছে যায় নেতিবাচক আঙ্গিকে। রাস্তার পাশে করোনা রোগীর লাশ দেখে স্থানীয়রাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এই দৃশ্য সঙ্গত কারনে দৃষ্টি কাড়লে মিডিয়া কর্মীরা তা গুরুত্বের সাথে নেয়। এবং নিতাই চন্দ্র শীলের পক্ষ অবলম্বনকারী তাদের সংগঠন অভিযোগ তোলে এই ঘটনার জন্য, শ্মশান কমিটির সাধারন সম্পাদক তমাল মালাকার দায়ী, তিনিই বাঁধা দিচ্ছেন। অবশ্য শারিরীক অসুস্থতাজনিত কারনে ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত শ্মশান কমিটির সভাপতি মানিক মূখার্জী কুটু তার সংগঠনের নেতার ভ’মিকা আইনসিক্ত দাবী করে ঐ অভিযোগ অবান্তর বলে সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের প্রতিউত্তরে মন্তব্য রেখে ছিলেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, এই নিয়ে যখন তোলপাড় তখন বিষয়টি জেলা পূজা উদযাপন কমিটির অন্যতম নেতা সুরঞ্জিৎ দত্ত লিটুর মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসেন এবং জেলা প্রশাসকের সাথে বিষয়টি নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজেন। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত উপনীত হয় যে, উভয় লাশের সৎকার এখানেই হবে। তখন প্রশ্ন ওঠে, করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত এই ব্যাক্তিদ্বয়ের সৎকার করবে কে? একপর্যায়ে শহরের জর্ডান রোড এলাকার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ামেন্ট ফাউন্ডেশন তাদের সৎকারে উদ্যোগী হয়। ততক্ষণে বেলা ১২ টায় শুরু হওয়া আবহাওয়া অফিস লাগুয়া কলোনীর স্বপন দাস’র দাহকার্য রাত ৭ টা নাগাদ শেষ হয়। এর কিছু আগে সন্ধ্যা ৬ টায় সম্পাদন হয় মোনলিসা মার্কেটের ব্যাবসায়ী কালা কর্মকারের সৎকার।
এই দুজনের সৎকার শেষে ৮ টার পরই কোয়মেন্ট ফাউন্ডেশনের সদস্যরা উপস্থিত হয়ে তাদের তদারকিতে করোনায় মৃত ব্যাক্তিদের দাহ করার নিয়ম অনুসারে প্রথমে মুলাদীর স্বপন মজুমদারের সৎকার শেষ হলেও রাত ১২ টা বেজে যায় নিতাই চন্দ্র শীলের সৎকারে ধর্মীয় কার্যাদি পালনে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবী, সৎকার নিয়ে নিতাই চন্দ্র শীলের পরিবার উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পর তার লাশ রেখে শ্মশান এলাকা থেকে সড়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে তমাল মালাকার এই প্রতিবেদককে আজ রবিবার সন্ধ্যায় আলাপকালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, যখন দুটি চুলোয় দুই মরদেহ দাহকাজ চলছিলো তখন চটজলদি নিতাই চন্দ্র শীলের দাহ করার চেস্টায় বাধা দেয়ায় তাকে ঘটনার অগ্রভাগে রেখে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। অন্য একটি সূত্র বলছে, শ্মশান কমিটি নিয়ে একটি বিরোধী পক্ষ প্রতিহিংসায় স্পর্শকাতর এই বিষয়টি ইস্যু হিসেবে লুফে নিয়ে বড় আকারে রূপ দিয়েছে কৌশলে।
সর্বশেষ জানা গেছে , এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে আজ রবিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মহাশ্মশান কমিটি ও বরিশাল জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমান মতবিনিময় করেন। এসময় করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যাক্তিদের সৎকারে সরকারের নিয়মাবলী পালনে অনঢ় থাকার নির্দেশ দেন। আগামীতে এধরনের বহিরাগত মৃত ব্যাক্তিদের সৎকার্য সম্পাদনে অবশ্যই জেলা প্রশাসকের অনুমতি মিললেই দাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ঐক্যমতে পৌছান।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বরিশাল মহাশ্মশান রক্ষা ও পূজা উদযাপন এই দুই কমিটির সভাপতি মানিক মূখার্জী কুটু, সাধারন সম্পাদক তমাল মালাকার ও মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির সহ-সাধারন সম্পাদকের অমর কুমার কুশিলালসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এসময় তারা শনিবার দুপুরের অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রকৃত রূপ তুলে ধরে এর পেছনে শ্মশানের নেতৃত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন। পাশাপাশি করোনার রোগীদের সৎকারে সরকারীভাবে ডোম নিয়োগসহ প্রতিরোধক ব্যাবস্থাস্বরূপ উপকরন সামগ্রীর প্রয়োজনীয়তার কথা অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে প্রাসঙ্গিত আলোচনার অংশ হয়ে ওঠে, এমনটি জানিয়েছেন বৈঠকে উপস্থিত জনৈক এক নেতা।