২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাচন : কে এই আব্দুল মালেক?

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

অনলাইন ডেস্ক ::: বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে এসেছে বড় চমক। আওয়ামী লীগের নেতাদের ভিড়ের মধ্যে থেকে জয়ী হয়েছেন সাবেক শিক্ষক আব্দুল মালেক। মালেকের রাজনীতি করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বরিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বছর দশেক আগে নিয়েছেন অবসর। এরপর অবসর জীবন যাপন করছিলেন। সেখান থেকে চমক দেখিয়ে তিনি হয়েছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

স্থানীয় লোকজন বলেন, প্রার্থী হওয়ার পরও কোনো মিছিল, উঠান বৈঠক কিংবা জাঁকজমক প্রচার-প্রচারণা ছিল না তাঁর। তাই ভোটের হিসাব-নিকাশে তিনি ছিলেন একেবারে গণনার বাইরে। কিন্তু গত বুধবার রাতে কেন্দ্র থেকে একে একে যখন ফলাফল আসছিল, তখন সব প্রার্থী ও ভোটারের চোখ কপালে ওঠে। রাত যত বাড়ে, কেন্দ্রগুলোর ফলাফল তত গুছিয়ে আসতে থাকে। পাল্টাতে থাকে হিসাব-নিকাশ। সবাইকে তাক লাগিয়ে এই প্রবীণ প্রার্থীই হাসলেন বিজয়ের হাসি।

কে এই আব্দুল মালেক?

আব্দুল মালেকের বয়স ৭০-এর কাছাকাছি। তিনি সদর উপজেলার চরবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। একসময় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বরিশাল জেলার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন। অবসরজীবনে তিনি ভাইয়ের ছেলে সালাহউদ্দীন রিপনের গড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এস আর সমাজকল্যাণ সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠানটি প্রত্যন্ত গ্রামের অসহায় মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছে।

আব্দুল মালেক বলেন, ‘আমি কখনো নির্বাচন করব, এমনটা ভাবিনি। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নেওয়ার পর এলাকায় শেষ জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচনে আসার পেছনে সমস্ত অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে আমার ভাইয়ের ছেলে রিপন। সে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে আমাকে প্রস্তাব দেয় উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার। প্রথমে বিষয়টিকে হাস্যকর মনে হয়েছিল। আমি একবারেই সেই প্রস্তাবে না বলে দিই। কিন্তু রিপন নাছোড়বান্দা। আমাকে নির্বাচনে দাঁড় করাবেই করাবে। এ নিয়ে অনেক দেনদরবার, পীড়াপীড়ি চলে। শেষ পর্যন্ত রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। মনোনয়নপত্র জমা দিই। আনুষ্ঠানিক কোনো প্রচার-প্রচারণা ছিল না আমার। কিন্তু আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়েছি। মানুষ আমাকে বিশ্বাস করেছে, ভোটের বাক্সে নীরবে সেই আস্থার প্রমাণ পেয়েছি।’

আওয়ামী লীগের কর্মীরা বলেন, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সালাহউদ্দীন রিপন। তখন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহর প্রচ্ছন্ন সমর্থন পান তিনি। এমনকি সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনেক নেতা প্রকাশ্যে সালাহউদ্দীনের মঞ্চে ওঠেন। কিন্তু তিনি জিততে পারেননি। গত সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হলেও হাল ছাড়েননি তিনি। এবারের উপজেলা নির্বাচনে তাঁর চাচা আব্দুল মালেককে কাপ-পিরিচ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামান তিনি। ভোটের মাঠে শেষ খেলায় চাচাকে বিজয়ী করে উপজেলাবাসীকে চমকে দিয়েছেন।

বরিশাল সদর উপজেলার ১০ ইউনিয়নবাসীর প্রতি আব্দুল মালেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার প্রধান কাজ হবে ১০ ইউনিয়নের জন্য সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা। সরকারের বরাদ্দের একটি টাকাও লুটপাটের সুযোগ থাকবে না। উপজেলা পরিষদ হবে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ এবং সবার জন্য উন্মুক্ত।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, বরিশালের ইতিহাসে এমন ঘটনা সত্যিই নজিরবিহীন। এমনটা আর কখনো ঘটেনি। এটা ব্যালট বিপ্লব বলা যায়। জনপ্রতিনিধিদের প্রধান কাজ জনগণের সেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু দেশে এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে দলের এবং নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। সাধারণ মানুষ এ ধরনের সংস্কৃতির পরিবর্তন চায়। এর প্রতিফলন ঘটেছে আব্দুল মালেকের বিস্ময়কর বিজয়ের মধ্য দিয়ে।

বিষাদে ডুবছে আওয়ামী লীগ

বরিশাল সদর উপজেলায় এবার আব্দুল মালেকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনিরুল ইসলাম। তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতা এস এম জাকির হোসেন, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মাহবুবুল রহমান। তাঁরা তিনজনই বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক ও সিটি মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। সব জল্পনা আর হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণ করে বিজয়ী হলেন মাঠের প্রচারে অনুপস্থিত আব্দুল মালেক। মালেকের এই বিজয়–ঘোরে আছেন আওয়ামী লীগের নেতারাও।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। মানুষ তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিয়েছেন। বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন। তবে এ ব্যাপারে আর কোনো মন্তব্য তিনি করতে চান না।

ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বিজয়ী চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক ১৯ হাজার ৮০৭ ভোট পেয়েছেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগের চার প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ৫০ হাজার ৬৯৩ ভোট। আব্দুল মালেকের সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান ২ হাজার ৪৯৩।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, আব্দুল মালেকের বিজয় বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য একটি বড় শিক্ষা হতে পারে। কেননা, এখানে আওয়ামী লীগের ভোট ভাগ হয়েছে চার প্রার্থীর মধ্যে। এর সুযোগ নিয়েছেন আব্দুল মালেক। মূলত সিটি নির্বাচন ঘিরে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এক পক্ষে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ এবং অপর পক্ষে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর জ্যেষ্ঠ ছেলে সাবেক সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। কিন্তু এবারের উপজেলা নির্বাচনে দেখা গেল, এখন বরিশালে রাজনীতি তিন ভাগে বিভক্ত। বর্তমান মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ও প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের মধ্যেও সুপ্ত মতবিরোধ এই নির্বাচনে প্রকাশ্যে এসেছে দুই নেতার অনুসারীদের প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়ে। এতেই আওয়ামী লীগের চার প্রার্থী মিলে হেরেছেন এবং বিজয়ী হয়েছেন একা থাকা প্রবীণ আব্দুল মালেক।

বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সংসদ সদস্য ও মেয়র—এই দুই নেতার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মীর আমিন উদ্দীন বলেন, ‘আমরা একটি নতুন নেতৃত্ব তৈরির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গত সিটি নির্বাচনে মাঠে নেমেছিলাম। কিন্তু নেতৃত্বের ভুলে সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন তো দূরে থাক, সবাই নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। যোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও নেতা বা জনপ্রতিনিধি হওয়ার এই প্রতিযোগিতা দলকে আরও বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। আব্দুল মালেকের জয় নিঃসন্দেহে একটি নীরব বিপ্লব, যা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে।’

সর্বশেষ