২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বাংলা সাংবাদিকতার গগণে উজ্জল নক্ষত্র আবুল কালাম শামসুদ্দীন

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

মুহাম্মদ আলতাফ হোসেনঃ

বিশ শতকের বিশের দশকে বাংলা সাংবাদিকতার ভূবনে আবির্ভাব হয় সাংবাদিকতার দিকপালদের গগনের অন্যতম নক্ষত্র আবুল কালাম শামসুদ্দীন’র। কুসংস্কার ও গোঁড়ামীর বিরোধী এবং মানবতাবাদী এই সাংবাদিক ছিলেন পাকিস্তানের শাসকদের স্বৈরাচারি চরিত্র ও দুর্নীতির আকুণ্ঠ প্রতিবাদি কণ্ঠ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি দু’য়েকটি গল্প-উপন্যাস লিখলেও তিনি ছিলেন মূলত প্রাবন্ধিক এবং সূক্ষ্মদর্শী ও নির্ভীক সাহিত্য সমালোচক। তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনে তিনি মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য ও সাংবাদিকতা চর্চায় আত্মনিবেদিত প্রাণ ছিলেন ।
সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৮৯৭ সালের ৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে জন্ম গ্রহণ করেন।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাস করার পর কলকাতার রিপন কলেজে বি.এ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯২০ ও ১৯২১ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং বি.এ পরীক্ষায় অংশ নিতে ব্যর্থ হন। পরে তিনি ১৯২ সালে কলকাতার গৌড়ীয় সুবর্ণ বিদ্যায়তন থেকে উপাধি পরীক্ষায় পাস করেন।
আবুল কালাম শামসুদ্দীনের গোটা কর্মজীবন জুড়েই আছে বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা আর লেখা-লেখি। বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপশি সাহিত্য চর্চা এবং গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি ছিল তার জীবিকার চালিকা শক্তি। এর পাশাপাশি কিছুকাল রাজনীতি ও পাকিস্তানের পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন।

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হলেও, আবুল কালাম শাসমুদ্দীন পেশা ও জীবিকার উপায় হিসেবে সাংবাদিকতাকেই অবলম্বন করেন এবং তাঁর পৌনে এক শতাব্দীরও অধিককালের সাংবাদিক জীবনে বৃটিশ আমলে ও বিভাগ পূর্বকালে ১৯২২ সালে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরূ হয়। এরপর তিনি একে একে সাপ্তাহিক মোসলেম জগৎ, দি মুসলমান, দৈনিক সোলতান, মাসিক মোহাম্মদী প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৩৬ সালে দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হলে তিনি সহযোগী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তিতে তিনি ১৯৪০ সালে এর সম্পাদক হন এবং ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন সুনিপুন ভাবে। সর্বশেষ তিনি ১৯৬৪ সালে ‘প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান’ পরিচালিত দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

মূলত সাহিত্যিক-সাংবাদিক হলেও, আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন রাজনীতি সচেতন, স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রেমিক, এবং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। প্রথম জীবনে এবং ছাত্রাবস্থায় কংগ্রেসের রাজনীতি এবং অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে অংশ নিলেও, পরবর্তীকালে ১৯২৭ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪২ সালে কলকাতায় পূর্বপাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হলে তিনি এর সভাপতি রুপে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ থেকে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনকালে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তিনি এমএলএ পদ ত্যাগ করেন। তৎকালীন গভর্ণরের কাছে পাঠানো পদত্যাগ পত্রে তিনি লিখেছেনঃ “বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদের আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নুরুল আমীন সরকারের আমিও একজন সমর্থক-এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে, ক্ষতমায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।”

মাতৃভাষা প্রেমিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন দৈনিক ‘আজাদ’-এর সম্পাদক হিসেবে বিভাগ-পূর্বকাল এবং সাবেক পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে অত্যন্ত সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং কয়েকজনকে হত্যার প্রতিবাদে আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে ইস্তফা দেন এবং তিনিই ২৬শে ফেব্রুয়ারী প্রথম শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।

সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সাহিত্য-চিন্তা ও দৃষ্টিকোণের পরিচয় তাঁর বিভিন্ন রচনায় স্পষ্ট। অর্ধ-শতাব্দীরও অধিককালের সাংবাদিক ও সাহিত্যজীবনে তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে বহুসংখ্যক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর ‘কাব্য সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান’, ‘মহাশ্মশান কাব্য’, ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’, ‘আমাদের সাহিত্য’, ‘বাংলা ভাষায় নয়া শব্দ’, ‘সাহিত্য গুরুর বাঙালি প্রীতি’ এবং ব্যঙ্গ্ রচনা ‘একটি জনসভার রিপোর্ট’ সময়কালিন সময়ে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ছাত্রজীবনে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বিদেশী সাহিত্যের-বিশেষত ইংরেজি ও রুশ সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ছিলেন।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্মাননা ও প্রদক প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি তৎকালিন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৯৬১ সালে সিতারা-ই-খিদমত এবং ১৯৬৭ সালে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুশুানের সময় ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর সম্পাদক থাকা সত্ত্বেও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থনে তিনি সরকার প্রদত্ত খেতাব বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৭৬ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত হন ।

বাংলা আত্মজীবনী হিসেবে ‘অতীত জীবনের স্মৃতি’ তাঁর উৎকৃষ্ট রচনা। দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর এ গ্রন্থ প্রত্যক্ষদর্শীর দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বাংলা একাডেমী কর্তৃক ৩ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে শামসুদ্দীনের ‘রচনাবলী’।

১৯৭৮ সালের ৪ মার্চ ঢাকায় বাংলা সাংবাদিকতা জগতের এই দিকপালের মৃত্যু হয়।

সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সাহিত্য চিন্তা ও দৃষ্টিকোণের পরিচয় তাঁর বিভিন্ন রচনায় স্বাক্ষরিত। অর্ধ-শতাব্দীরও অধিককালের সাংবাদিক ও সাহিত্যজীবনে তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে বহুসংখ্যক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সাহিত্য, সমাজ-সংস্কৃতি ও জাতীয়তা বিষয়ে চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচনা ছাড়াও সাহিত্যকর্মের একটা প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে সাহিত্য সমালোচনা। উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও আবুল কালাম শামসুদ্দীন অহমিকাবোধে কখনো আচ্ছন্ন হননি, অত্যান্ত সরল ও সাদাসিধা জীবন যাপন করেছেন, যশ ও খ্যাতির পেছনে কিংবা বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলার লক্ষ্যে কখনো প্রচেষ্টা চালাননি।

 

লেখকঃ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সভাপতি- জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা

সর্বশেষ