৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভোলায় ধুলো মাখা শিশুর শৈশব ॥ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ইটভাটার শিশু শ্রমিকরা

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email


ইমতিয়াজুর রহমান ॥
ভোলায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইটভাটাগুলোতে বছরের বড় একটা সময় জুড়ে চলে আসছে শিশু শ্রমের মহাউৎসব। এ যজ্ঞের আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ছে হাজার হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ। অধিক লাভের আশায় সরকারী আইন অমান্য করে প্রোলোভন দেখিয়ে কম মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে নিয়োগ করাচ্ছেন তারা।
দারিদ্রের বেড়াজালে বন্দি হয়ে ইটভাটাগুলোতে চাপা পড়ছে এসব শিশুর ‘রঙিন’ ভবিষ্যৎ। যে বয়সে তাদের থাকার কথা বাবা মায়ের আদরে, সেখানে তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ব্যস্ত সময় পার করছে। এতে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে এসব শিশুরা।


এমনটাই দেখা মিলেছে ভোলা সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটায়। দুপুর বেলা রোদের মধ্যে কাজ করছে একদল শিশু। এদের সবারই বয়স ৮ থেকে ১৬ বছর। জীবন-জীবিকার তাগিদে কাজ করছেন তারা।
ভোলা সদর সেভেন স্টার ব্রিকস ফিল্ডে গিয়ে দেখা যায়, রমজান সহ স্কুল পড়–য়া কয়েকজন শিশু ভাটাটিতে কাজ করছে। এক হাজার কাচা সাঁঝে করে ইট শুকানোর জন্য প্রতিটি জনকে দেওয়া হয় মাত্র দুইশত টাকা। অথচ এই কাজ করানোর জন্য একজন শ্রমিক নিয়োগ দিলে তাকে দিতে হতো ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। মজুরি সাশ্রয় করতে আইন অমান্য করে এভাবে শিশুদের কাজে লাগাচ্ছেন ভাটার মালিকরা।
এই অবস্থা দেখা গেছে সদর উপজেলার উওর দিঘলদী ইউনিয়নের মের্সাস রহমান ব্রিকস (গজই) ব্রিকস ফিল্ড, মিতালী ব্রিকস ফিল্ড, চরফ্যাশনের আলম ঝিকঝাক ব্রিকস সহ বেশ কয়েকটি ইটভাটায়।
ভোলা সদর উপজেলা পশ্চিম ইলিশায় ফাইভ স্টারে দেখা যায় দক্ষিন চরপাতা মাধদ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মো. শাওন (১৪) ও মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্র মহিম (৭) ওই ভাটায় কাজ করে। তারা ভাটা থেকে ট্রাক ও লরিতে ইট তুলে দেন এবং ক্রেতার বাড়িতে তা নামিয়ে দেন। এই কাজ করার জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে পান ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
ভোলা জেলায় মোট ইটভাটা রয়েছে ১২৫টি যার মধ্য চালু আছে ৯৫টি। এই ৯৫টি ইটভাটার মধ্য প্রায় ভাটাতেউ অসংখ্য শিশু কাজ করছে। তাদের মধ্য অনেকে চুল্লিতে কয়লা বা কাঠ দেওয়ার কাজও করছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় মাটিভর্তি ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে দেখা যায় শিশুদের।
এসব শিশুরা সাতক্ষীরা খুলনা সহ বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে ছয় মাসের কাজের চুক্তিতে। চুক্তি ফুরালেই আবার ফিরবেন আপন ঘরে। তবে ততো দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হবে পুরোমাত্রায়।
ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়ার ব্যাংকেরহাটে অবস্থিত মেসার্স সুরমা ব্রিকসের সত্বাধীকারি মোঃ সানজিদুল ইসলাম শুভর কাছে ইট ভাটায় শিশুদের কাজে নিযুক্ত করার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কোন শ্রমিক নিয়োগ দেই না সরদারের কাছে আমরা কাজদেই সরদারাই কাজ উঠিয়েদেয়। মূলত শিশুদের কেউ কাজে নেয় না। স্থানিয় কিছু শিশু কাচা ইট যখন চেঙ্গি (রোদে শুকানোর সময় উল্টিয়ে দেওয়া) দেওয়া সময় হয় তখন তারা নিজ ইচ্ছায় এসে চেঙ্গি দিয়ে যায়। পরে সর্দার থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেয়। তা ছাড়া আমাদের মালিক সমিতি থেকে শিশু শ্রমিক কাজে নেওয়া নিষেধ আছে।
ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে শিশুদের নিযুক্ত করার বিষয়ে ভোলা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক তরিকুল ইসলাম কায়েদ জানান, আমাদের ইটভাটা মালিক সমিতির আওতায় কোন ইটভাটাতেই শিশু শ্রমিক নেই। আমাদের ভাটা গুলো শ্রম অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স করা। কেউ শিশুশ্রমিক নিয়োগ দিলে বা শিশুদের কাজে রাখলে তাদের জরিমানা করা হয়।
ভোলা সিভিল সার্জন ডাঃ সৈয়দ রেজাউল ইসলাম বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থানে ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ইটভাটায় দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, এজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ভোলা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিজানুর রহমান বলেন, শ্রম আইন-২০০৬ এর ২৮৪ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে, অথবা আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশুকে চাকরি করার অনুমতি দিলে, তিনি ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে দ-িত হবেন। যে সব ইটভাটায় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ