ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কোড়কদী ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামে জোরপূর্বক জমি দখল করতে না পেরে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে কৃষক সিদ্দিকুর রহমান মোল্লাকে (৬৩)। হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাজপথে নেমেছেন পরিবারের সদস্যরা, স্বজন ও স্থানীয় এলাকাবাসী। মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসী।
মানববন্ধন চলাকালে স্থানীয় এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য। বক্তারা বলেন, জোরপূর্বক জমি দখল করতে না পেরেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় কৃষক সিদ্দিকুর রহমান মোল্লাকে।
শুক্রবার রাতে সিদ্দিকুর রহমান মোল্লা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার ছেলে কামরুল মোল্লা বাদী হয়ে ৬০ জনকে আসামি করে মধুখালী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। শনিবার মামলাটি রুজু করা হয়েছে। মামলা নম্বর-৪।
এর আগে শুক্রবার সকাল ১০ টার দিকে নিহত সিদ্দিকুর রহমানের মরদেহ নিয়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের বাগাট বাজারে বিক্ষোভ মিছিল বের করে স্থানীয় এলাকাবাসী। পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।
মানববন্ধন কর্মসূচি চলাকালে বক্তব্য রাখেন-উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক বকু, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুরাদুজ্জামান মুরাদ, উজ্জ্বল হোসেন, নিহতের ছেলে কামরুল, ভাতিজা মাসুদ, রব মোল্যা, কামাল হোসেন প্রমুখ।
মানববন্ধন শেষে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে এলাকাবাসী। পরে পুলিশ হত্যাকারীদের গ্রেফতারের আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেয় তারা।
মানববন্ধনে কাটাখালী গ্রামের বাসিন্দা উজ্জ্বল হোসেন বলেন, কৃষক সিদ্দিকুর রহমানকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে জমি-জমা নিয়ে বাগাট ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান খান, বাগাট বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন খান লাল ও আহমেদ আলীর সাথে বিরোধ চলছিল সিদ্দিকুরের। জমি দখল করতেই সিদ্দিককে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা।
তিনি আরো বলেন, বাগাট বাজার সংলগ্ন খোদাবাসপুর মৌজায় তিনটি জমি রয়েছে সিদ্দিকুর ও তার ভাইদের নামে। জমিগুলো তারা প্রায় ৬০ বছর ধরে ভোগ দখল করে আসছিল। সম্প্রতি ওই জমিগুলোর মধ্যে অংশ রয়েছে বলে দাবি করে আসছিল মতিয়ার খান, লাল খানসহ তাদের ভাইয়েরা। এই জমি জোড়পূর্বক দখল নিতে লাল খান ও তার লোকজনের সাথে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে সহযোগিতা করে আসছিল সাবেক ইউপি সদস্য আহমেদ আলী।
উজ্জ্বল বলেন, জমি দখল নিতে লাল খান ও আহমেদ আলী বিভিন্ন সময়ে নিহত সিদ্দিক ও তার ছেলেদের হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিল। এমনকি সিদ্দিককে প্রাণে মেরে ফেলারও হুমকি দিয়েছিল তারা। এরই ধারাবাহিকতায় লাল খান তার সহযোগী আলমগীর, হাফিজুর, মামুন, সুজাত, মাহবুব সহ ৪০/৫০ জনকে সাথে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে সিদ্দিকুরের বাড়িতে গিয়ে হামলা চালায়। হামলায় সিদ্দিকুর মারা যায়। এসময় সিদ্দিকুরের ছেলে কামরুল সহ কয়েকজন গুরুতর আহত।
তিনি বলেন, সিদ্দিকুর মৃত্যুর আগে বিষয়টি এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে জানিয়েছিল কিন্তু লাল খান স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না।
নিহত সিদ্দিকুরের ছেলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহত কামরুল জানান, তিনি বৃহস্পতিবার ভোরে মাগুরা বাজারে মরিচ বিক্রি করতে যান। মরিচ বিক্রি করে বাড়িতে ফিরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ভাত খাচ্ছিলেন। এমন সময় লাল খান সহ আহমেদের ৪০-৫০ জন সমর্থক রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তার বাড়িতে এসে তাকে ও তার বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তিনি ও তার বাবা যেতে অস্বীকার করলে রামদা দিয়ে কোপ দেন তারা। আহত হন তিনি ও তার বাবা সিদ্দিকুর। বাবার বুকের ডান পাশে রাম দায়ের কোপ লাগে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি আরো জানান, বাগাট বাজার সংলগ্ন খোদাবাসপুর মৌজায় তাদের ১ একর ৮৫ শতাংশ, ২৯ শতাংশ ও ৩৮ শতাংশের তিনটি জমি রয়েছে। এই জমিগুলোর মধ্যে ১ একর ৮৫ শতাংশ জমিতে ৩৫ শতাংশ, ২৯ শতাংশ জমিতে ১০ শতাংশ এবং ৩৮ শতাংশ জমিতে ১৩ শতাংশ জমি দাবি করে আসছিল মতিয়ার খান, লাল খান ও আহমেদ আলী।
কামরুল জানান, জমিগুলো প্রায় ৬০ বছর আমরা দখলে রয়েছি। দীর্ঘ দিন যাবত জমিগুলো দখল করতে মতিয়ার খান, লাল খান, আহমেদ আলী সহ তার লোকজন আমার বাবা সহ পরিবারের সদস্যদের হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিলেন। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেও জমিগুলো দখল নিতে না পারায় আমাদের উপর হামলা চালায় তারা। আমার বাবার জীবন কেড়ে নিল ওরা। আমি আমার বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।
নিহত সিদ্দিকুর রহমান মোল্লার স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, আমার স্বামী খুব নিরীহ মানুষ ছিলেন। তিনি কারো সাথে কোনোদিন খারাপ আচরণ করেননি। তবুও ওরা নিরীহ মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করলো।
কোড়কদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মুকুল হোসেন বলেন, জমি-জমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে সিদ্দিকুরকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় তার ছেলেসহ তিনজনকে আহত করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার পূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম বলেন, কোড়কদী ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামে কৃষক সিদ্দিকুর রহমান মোল্লা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা রুজু করা হয়েছে। নিহতের ছেলে বাদী হয়ে বাগাট ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান খান সহ ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। শনিবার মামলাটি রুজু করা হয়েছে। মামলা নম্বর-৪। আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
এ দিকে হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বাগাট ইউপি চেয়ারম্যান মো. মতিয়ার রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, আমি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত নই। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের মামলায় জড়ানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মধুখালী উপজেলার কোড়কদী ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামে সিদ্দিকুর রহমান মোল্লা (৬৩) এর বাড়িতে হামলা চালায় শাহাদাত হোসেন খান লাল সহ তার সহযোগীরা। হামলায় কৃষক সিদ্দিকুরের বুকের ডান পাশে রাম দায়ের কোপ লাগে। আহত হয় সিদ্দিকুরের ছেলে কামরুলসহ বেশ কয়েকজন। পরে এলাকাবাসী সিদ্দিকুরসহ আহতদের উদ্ধার করে মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক সিদ্দিকুরকে মৃত ঘোষণা করেন।