২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মুলাদীতে সরকারি হাসপাতালে ৪ রোগী, স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ক্লিনিকে দীর্ঘলাইন

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

বরিশালের মুলাদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নানা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘিরে অন্তত ২০-২৫ জনের একটি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব দালালের হাতে জিম্মি রোগী ও তাদের স্বজনরা।

রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, বেশির ভাগ অসুস্থ রোগীদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি নেয়া হয় না। নানা অজুহাত দেখিয়ে পাঠানো হয় শহরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে। জোর-জবরদস্তি করে যারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন, তারা নিয়মিত চিকিৎসকের দেখা পান না। ওষুধপত্র দেয়া হয় না। বাধ্য হয়ে রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়।

একই সঙ্গে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। দক্ষ লোকবল নেই এমন অজুহাতে কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্যাথলজি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। একই ভাবে অপারেশন থিয়েটার থাকলেও অস্ত্রোপচার করা হয় না রোগীদের।

স্থানীয়দের অভিযোগ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ফেলে রাখা হয়েছে। ১০ বছর ধরে সেগুলো স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাক্সবন্দি রয়েছে এক্স-রে মেশিনসহ অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি।

স্থানীয়রা জানায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেসরকারি ক্লিনিকের মালিকদের চুক্তি রয়েছে। রোগী পাঠালে সেখান থেকে অনেক টাকা পান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা। এজন্য প্যাথলজি কার্যক্রম এবং রোগীদের অপারেশন করা হয় না। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাইয়েদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। ওই সিন্ডিকেট রোগীদের দালাল, রোগীদের খাবার, রোগীদের সনদ প্রদান, ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছ থেকে কমিশন আদায়সহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। নতুন কোনো চিকিৎসক এলে সিন্ডিকেটের কথামতো চলতে হয়। কথা না শুনলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এতে কাজ না হলে তাকে বদলি করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ১১ বছর ধরে সাইয়েদুর রহমান মুলাদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। তার বাড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন সদর রোড এলাকায়। এর মধ্যে অনিয়মের অভিযোগে বরিশালের হিজলা উপজেলায় ও চট্টগ্রামে তাকে বদলি করা হয়েছিল। তবে ৮-১০ দিনের মধ্যে তদবির করে বদলি নিয়ে মুলাদীতে ফের যোগ দেন তিনি।

তিন বছর আগে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান সাইয়েদুর রহমান। এরপরও তিনি একই কর্মস্থলে থেকে গেছেন। মুলাদী শহরে তিনি ও আরও দুইজন চিকিৎসক মিলে ‘ফেয়ার ক্লিনিক’ নামে একটি ক্লিনিক গড়েছেন। ওই ক্লিনিকের পরিচালক পদে রয়েছেন তিনি। তার সব চিন্তা-ভাবনা ক্লিনিক ঘিরে। সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীদের নিজের ক্লিনিকে পাঠান তিনি। তারপর সেখানে গিয়ে চিকিৎসা দেন সাইয়েদুর রহমান।

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুলাদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দালালদের উৎপাত নিত্যদিনের ঘটনা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে চোখে পড়ে দালালদের রোগী নিয়ে টানাটানির দৃশ্য। তাদের বাধা পেরিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের কাছে কোনো রোগী পৌঁছে না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঢোকার প্রধান গেট সংলগ্ন ওষুধের দোকান ও চারটি পান-সিগারেটের দোকানে দালাল চক্রের সদস্যরা বসে থাকেন। রোগী আসা মাত্রই বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যান।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাত্র ছয়জন রোগী রয়েছেন। বাকি ৪৪টি শয্যা খালি। তবে পাশে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ক্লিনিকে রোগীদের প্রচুর চাপ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন চিকিৎসক ক্লিনিক ব্যবসায় জড়িত। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী দেখার পর তারা ক্লিনিকে নিয়ে যান। ব্যবস্থাপত্রে লেখা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তদের ক্লিনিক সেন্টারে যেতে বলেন। করোনা ইউনিট কিংবা আইসোলেশন বেড না থাকায় করোনা রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে মুলাদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১-৫০ শয্যায় উন্নীত করণের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শেষে ২০১৭ সালে নতুন ভবনের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর পর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলেও অদৃশ্য কারণে তা স্থাপন না করে ফেলে রেখে অকেজো করে দেয়া হয়েছে।

এক্স-রে অপারেটর না থাকায় ২০০৬ সাল থেকে এক্স-রে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। টেকনিশিয়ান না থাকায় ২০১৭ সাল থেকে প্যাথলজিতে কোনো প্রকার পরীক্ষা হচ্ছে না। চার মাস আগে হাসপাতালে একজন ডেন্টাল সার্জন যোগদান করলেও ডেন্টাল ইউনিট না থাকায় রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না। ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৮ জন চিকিৎসকের স্থলে কর্মরত রয়েছেন ১৬ জন।

এসব বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাইয়েদুর রহমান বলেন, রোগীদের নিয়ে দালালদের কিছুটা উৎপাত রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় দালালবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এর মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। এখন দালালের উৎপাত কমে গেছে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ফেলে রাখার বিষয়ে ডা. সাইয়েদুর রহমান বলেন, ২০১০ সালে যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়েছিল। তখন নতুন ভবন নির্মাণ হয়নি। তাই যন্ত্রপাতি স্থাপন করা যায়নি। নতুন ভবনে যন্ত্রপাতি স্থাপন করার জন্য বলা হয়েছে। শিগগিরই যন্ত্রপাতি স্থাপন করে অপারেশন থিয়েটার ও প্যাথলজি কার্যক্রম চালু করা হবে।

বেসরকারি ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন কি-না জানতে চাইলে ডা. সাইয়েদুর রহমান বলেন, বিকেলে হাসপাতালের সামনের একটি চেম্বারে রোগী দেখি। আমি কোনো ক্লিনিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। মুলাদী শহরের বাসিন্দা আমি। তাই এলাকার সবাই আমাকে চেনেন এবং সম্মান করেন। নিজ এলাকায় থাকায় অনিয়ম দূরের কথা কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যায় না।

এ বিষয়ে বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন বলেন, মুলাদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাইয়েদুর রহমানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত লিখিত কোনো অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে।

সূত্র- জাগো নিউজ

সর্বশেষ