২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাহান আরা আবদুল্লাহ : বিনম্র শ্রদ্ধা –অজয় দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

অজয় দাশগুপ্ত:
আমাদের গৈলা ইউনিয়নের সেরাল এলাকার কৃতী সন্তান আবদুর রব সেরনিয়াবাত। তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট বোন আমেনা বেগমের স্বামী। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে ১৯৪৭ সালের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেনÑ ‘পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে কলকাতায় চলে আসি। হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি। আমার ছোটবোনের স্বামী বরিশালের এডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত তখন পার্ক সার্কাসে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। আমার বোনও থাকত, তার কাছেই উঠলাম। কিছুদিন পর রেণুও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।’ [পৃষ্ঠা ৭১-৭২]আবদুর রব সেরনিয়াবাত সদা হাসিখুশি মানুষ। কথা বলতেন মৃদু স্বরে। ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। সমাজসেবা ও শিক্ষা প্রসারে প্রবলআগ্রহ। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী গৈলা স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সম্পাদক হিসেবে বহু বছর দায়িত্ব পালন করেছেন সুনামের সঙ্গে। তাঁর পিতা আবদুল খালেক সেরনিয়াবাত ছিলেন গৈলা ইউনিয়ন বোর্ডের জনদরদী প্রেসিডেন্ট।
আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে আমার বাবা সত্যরঞ্জন দাশগুপ্ত জেল খেটেছেন পঞ্চাশের দশকে। পাকিস্তান আমলে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্তদের সঙ্গে আমার বাবা সুসম্পর্ক রেখে চলতেন। ছোট বয়সে আবদুর রব সেরনিয়াবাতকেও এ কারণে আমাদের গৈলা দাশের বাড়িতে দেখেছি। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় ঝুঁকি ছিল। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর প্রায়শই চৌকিদার, দফাদার এসে বাবার খোঁজ নিত। নজর রাখত বাড়িতে বাড়িতে কে কে আসে। হেনস্তাকরা হতো অনেককে।
বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্য থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। আবদুর রব সেরনিয়াবাত মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সেচ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ, বনসহ কয়েকটি দফতর সামলান দক্ষ হাতে।বাকশালের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়েছে ৭ জুন। ২১ জন নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয়েছে আমাকে। কমিটি গঠনের দু’তিন দিন পর তাঁর সঙ্গে মিন্টো রোডের বাসায় দেখা করতে যাই। আমি ড্রয়িং রুমে বসতে না বসতেই বঙ্গবন্ধুর ফোন। রাতে ৩২ নম্বরের বাসায় যেতে বলছেন। অবাক বিস্ময়ে শুনি রব সেরনিয়াবাত বলছেনÑ আমাদের এলাকার এক ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা বলছি।কয়েকদিন পর এলাকায় একসঙ্গে যাব। ওর সঙ্গে কথা শেষ করে আপনার কাছে আসছি। এ সময়ে তিনি গৈলার বিখ্যাত জমিদার পরিবার মুন্সি বাড়ির পরিত্যক্ত ভূ-সম্পত্তি আধুনিক কৃষি খামারের পাইলট প্রকল্প হিসেবে ব্যবহারের স্বপ্নের কথা বলেন।
কথা চলতে চলতেই অনেক খাবার নিয়ে এলেনসাহান আরা আবদুল্লাহ। প্রথম পরিচয়। কিন্তু তিনি আন্তরিকতায় পূর্ণ। মাত্র কয়েকদিন পরেই এ বাড়িতে বাংলাদেশের ইতিহাসের করুণতম অধ্যায় রচিত হবে, কে জানত।১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। আমরা জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা ১০ জুন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে এ বিষয়ে কথা হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীদের আসার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যারা চায়নি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা যাদের দুই চোখের বিষ, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাংলাদেশ যাদের গায়ে জ্বালা ধরায় সেই অপশক্তি আঘাত হানে। প্রায় একযোগে আক্রান্ত হয় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি, যেখানে সাধারণ মানুষের মতো বসবাস করতেন জাতির পিতা, বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানেই নিহত হন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমাদের সহকর্মী শেখ কামাল, সেনাবাহিনীর তরুণ চৌকষ অফিসার শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল। শেখ কামাল ও শেখ জামালের কয়েকদিন আগেই বিয়ে হয়। একেবারেই সাধারণ আয়োজন ছিল বিয়েতে। শেখ কামালের ‘বৌ-ভাতে’ গণভবনে খাবারের মেনু ছিল সিঙ্গারা ও মিষ্টি। আর শেখ জামালের বিয়ে হয় একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশে। কেবল নিকট আত্মীয়েরা এ বিয়ের খবর জানত।তাদের দু’জনের স্ত্রীকেও ঘাতকেরা হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে দুই নবপরিনীতার বিয়ের কাপড় প্রদর্শন করা হয়। জাদুঘর পরিদর্শনে আসা একটি নিুবিত্ত পরিবারের কয়েকজন সদস্যর মন্তব্য আমি শুনেছিÑ ‘দেখ, আমাগো মতো বিয়ের কাপড়’। এই ছিল আমাদের জাতির পিতার জীবন!
এ দিনে মিন্টো রোডের বাড়িতে হামলায় নিহত হন আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, কন্যা বেবি, নাতি সুকান্ত বাবু ও ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত। আহত হন আমেনা বেগম, সাহান আরা আবদুল্লাহ, বিউটি সেরনিয়াবাত, বেলা সেরনিয়াবাত, সাদিক আবদুল্লাহ। ঘাতকেরা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে ওই বাড়িতে খুঁজেছে। কিন্তু অলৌকিকভাবে তিনি প্রাণে বাঁচেন।
ধানমণ্ডির আরেক বাড়িতে একই ধরনের হামলায় নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের ছেলে শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মনি। আরজু মনি ছিলেন সন্তানসম্ভবা। তিনি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মেয়ে।
এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল সুগভীর চক্রান্ত। রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি তারা সতর্ক ছিলÑ যেন কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে উঠতে না পারে।
১৫ আগস্ট সকালে আমরা ছাত্রদের প্রতিবাদী বিক্ষোভ সংঘটিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাঙ্ক-মেসিনগান আসে। এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। রমজান ও শারদীয় দুর্গা পূজার কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দেড় মাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ কারণে প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে সোচ্চার হতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় ২০ অক্টোবর পর্যন্ত। পর পর কয়েকদিন মিছিল-সমাবেশ করার পর আমরা ঘোষণা করি ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শোক মিছিল নিয়ে যাব। এ সময়ে বঙ্গভবনে অবস্থানকারী খুনিচক্র হুঙ্কার ছাড়েÑ রাজপথে নামলে পাখির মতো গুলি করে মারা হবে। আমরা কোনো বাধা মানিনি। পরদিন ৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ও জেল খানায় জাতীয় চারনেতা হত্যার প্রতিবাদে আমরা ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে ঢাকায় হরতাল আহ্বান করি। হরতাল শেষে বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুর স্বজন ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের পরিবারগুলোর দুঃসহ-বেদনাবহ জীবন। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহসহ তরুণ সদস্যদের জীবননাশের হুমকি। নাগালে পেলে নিশ্চিত মৃত্যু। মিলিটারি শাসন চলছে। জেলে শত শত আওয়ামী লীগ-বাকশাল নেতা-কর্মী।চাকরি ও ব্যবসায় সমস্যা। কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। সন্তানরা স্কুলে-কলেজে যেতে পারে না। অপপ্রচার চলছে নানাভাবে। একটি অপপ্রচার ছিলÑ শেখ মুজিব চেয়েছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে প্রধানমন্ত্রী, শেখ ফজলুল হক মনিকে বাকশালের সেক্রেটারি ও শেখ জামালকে সেনাবাহিনী প্রধান করতে। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা-দক্ষতা ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাছে পরিবারের চেয়ে দেশ ও দলের স্বার্থ ছিল অনেক ওপরে।
১৯৮১ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৭ মে ফেরেন বিপুল অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়ে প্রিয় বাংলাদেশে। কিন্তু ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে পিতার বাসবভবন ফিরে পেতে তাকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে ভেতরে প্রবেশ করে দেখেনÑ যে বাড়িতে থেকে জাতির জনক স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন সেই ঐতিহাসিক বাবভবনের স্মৃতিচিহ্নগুলো সব লুট হয়ে গেছে।
এরপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু কন্যার নতুন সংগ্রামÑ সামরিক শাসনের অবসান এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। এ কাজে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ফিরে এলে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে জাতীয় সংসদের চীফ হুইপের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের অশান্তির অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার দুরুহ কাজের নেতৃত্ব ভারও অর্পিত হয় তাঁর ওপর। আর এ সময়েই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। গৈলা স্কুলের একটি অনুষ্ঠানের বিষয়ে জাতীয় সংসদে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আমাকে বলেনÑ দক্ষিণাঞ্চল খুব অবহেলিত। তুমি যেহেতু সাংবাদিকতা পেশায় সক্রিয় এবং রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছেÑ এ অঞ্চলের উন্নয়নের বিষয়টি সবসময় সামনে রাখবে। আরেকটি বিষয়Ñ গৈলা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এলাকা। ব্রিটিশ আমলে আর কোনো গ্রামে শিক্ষার এমন প্রসার ঘটেনি। গৈলাকে পৌরসভা ঘোষণার পেছনেএ সমৃদ্ধ জনপদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার মনোভাব কাজ করেছিল। পরবর্তী সময়ে পদ্মা সেতু নিয়ে আমার যে সব লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তাঁর প্রশংসা পেয়েছি। তিনি বলেছেন, বরিশালবাসী আমরা প্রকৃতির কাছে জিম্মি। ঝড়-বাদলের দিনে লঞ্চ-ফেরি বন্ধ থাকে। শীতের কুয়াশাতেও সব বন্ধ। একটি লেখার শিরোনাম দিয়েছিলামÑ ‘পদ্মা সেতু চালু হলে বরিশাল থেকেই প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করা যাবে’। তিনি পছন্দ করেছিলেন। এখন তাঁর স্বপ্ন পয়সারহাট এলাকায় অর্থনৈতিক এলাকা প্রতিষ্ঠা। ‘পয়সারহাঁটে টাকার গাছ!’ শিরোনামের লেখাটি ছিল তাঁরই অনুপ্রেরণায়।
সাহান আরা আবদুল্লাহর সঙ্গে কাজের সুযোগ ঘটে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত স্মৃতি সংসদ-এ সক্রিয় হওয়ার সুবাদে। আমরা কৃষক দরদী ও মানবতাবাদী এ রাজনীতিকের কর্মকাণ্ড তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নিই। মিন্টো রোডের যে বাড়িতে ১৫ আগস্ট তিনি নিহত হয়েছেন, সেখানে একটি জাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। জাতীয় জাদুঘরে এক আলোচনা সভায় সাহান আরা আবদুল্লাহ প্রথমবারের মতো ১৫ আগস্টের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি কাঁদছিলেন, মিলনায়নপূর্ণ প্রতিটি নরনারী কাঁদছিল।
একবার শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় তিনি খবর পাঠালেন, আমাদের গৈলা দাশের বাড়ি যাবেন। আমার বাবা-মাকে শুভেচ্ছা জানাবেন। পূজার সময় অতিথি এলে খাবারের আয়োজন হয়, এটা তিনি জানতেন। তিনি খবর পাঠালেনÑ খিচুরি ও বেগুন ভাজা ছাড়া অন্য কোনো আইটেম করা যাবে না। অনেকের সঙ্গে তিনি চকির ওপর বসে খিচুরি খেয়েছিলেন।
আরেকবার পূজার পর লঞ্চে গৌরনদী থেকে ঢাকা আসব। গৌরনদীর আড়িয়াল খাঁ শাখা নদীতে আয়োজন ছিল নৌকাবাইচের। সাহান আরা আবদুল্লাহ প্রধান অতিথি। তিনি আমাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চে ডাকেন।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের সময় গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায় ফের দুঃসময়। শত শত নারী-পুরুষ দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তারা বাধ্য হয় জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা রামশীলে আশ্রয় নিতে। এ যেন আরেক একাত্তর! আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নিজের বাড়িতে থাকা সম্ভব ছিল না। অনেকের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছে অনেকে। একটি পরিবারের এক সদস্য তাদের ওপর পরিচালিত বর্বরতার ঘটনা আমার অগ্রজ আশীষ দাশগুপ্তকে বলেছিল। কেন এটা বলল, সে জন্য বিএনপির কয়েকজন নেতা আরেকবার ওই পরিবারটিকে হেনস্তা করে। সে সময়ে আমি সাহান আরা আবদুল্লাহর সঙ্গে পরামর্শ করে নির্যাতিত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। তাঁর নিজের জীবনের ঝঁকি ছিল। আবদুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সন্তানদের জন্য ঝুঁকি ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভিকচিত্তের। দলের অনেক কর্মী জেলে, মামলা দায়ের হয়েছে অনেকের নামে। সবার পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন।
এখন এসবই ম্মৃতি। কলাগানের বাসায় একবার গিয়েছি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বলল, শুক্রবার সকালে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না। বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্ট পরিবারের নিহত সদস্যদের জন্য দোয়া করেন। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কর্মসূচি ছিল। তাই দেরি না করে চলে আসি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাহান আরা আবদুল্লাহর ফোনÑ কেন এমন কাজ করলাম? নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য আমি চলে আসার পর পরই জানিয়েছিল আমার যাওয়ার খবর। আমার জরুরি কাজ থাকায় তখন যেতে পারিনি। কিন্তু অঙ্গীকার করতে হয়Ñ পরদিন সকালে তাঁর বাসায় নাস্তা করতে হবে। গিয়ে দেখি দু’জনেই আমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। খেতে খেতে হাসানাত ভাইকে বিএনপির এক নেতার অসুস্থতার কথা বলি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে তার খোঁজ নেন। বরিশালের আরেক ভাসানী ন্যাপ নেতা মজিবর রহমান চাঁন মিয়া আমাকে বলেছেন, তাঁর সুচিকিৎসায় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বার বার সহায়তা করেছেন। খোঁজ-খবর রেখেছেন।
২০০৪ সালে গৈলার বিজয়গুপ্তের মনসা দেবী মূর্তি ও মন্দির নতুন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। রণজিত সমদ্দার ও আমি এ নিয়ে কয়েকবার সাহান আরা আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলি। তখন রাজনৈতিকভাবে দুঃসময়। তাকেও সাবধানে থাকতে হয়। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য একবার উত্তরার এক বাসায় যেতে বলেন, যেখানে তাকে অনেকটা গোপনে বসবাস করতে হয়। আমাদের যেতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কাছাকাছি সময়েই গৌরনদী এলাকায় ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। তিনি দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে তৎপর হন। অনেকের কাছে সহায়তার জন্য হাত বাড়ান এবং সফল হন।
সাহান আরা আবদুল্লাহ রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য। এ এক ভিন্ন জগৎ, যে বিষয়ে অনেকের স্পষ্ট ধারণা থাকে না। তাকেও এ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও তিনি এক আটপৌড়ে সাধারণ বাঙালি নারীর জীবনযাপন করে যেতে পেরেছেন, যার কাছে সহজেই যাওয়া যায়। যে কোনো সমস্যার কথা বলে মনের শান্তি পাওয়া যায়। ঘরোয়া গানের আসরে তিনি পরিচিতদের আমন্ত্রণ জানাতেন। অনেকের পারিবারিক ও সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। বহুজনকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন।
বরিশাল শহর এবং গোটা বরিশাল বিভাগের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যুক্তদের জন্য তিনি ছিলেন বড় ভরসাস্থল, আপনজন। ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে তাঁর একাধিক বক্তৃতা শুনেছি। শিল্প-সাহিত্যেরও প্রকৃত সমজদার তিনি। শিল্পীদের প্রিয় মানুষ।
করোনাকালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ব্যক্তি জীবনের এমন শোকতাপেও প্রজ্ঞাবান-বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতা কেমন হওয়া উচিত, তার অনন্য নজির স্থাপন করতে পারেন। বরিশাল অঞ্চলের মানুষ দলে দলে ছুটে আসবে শ্রদ্ধা ও শোকপ্রকাশে, এটা তিনি জানতেন। তাই জানাজা ও দাফনের আয়োজন করেন স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণভাবে মেনে। কিন্তু এখন বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা সাহান আরা আবদুল্লাহর প্রতি যেভাবে সর্বস্তরের মানুষকে শোক প্রকাশ করতে দেখছি, নিশ্চিত করে বলতে পারি তিনি থাকবেন আমাদের অন্তরে।
তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরপ্রতি আমাদের গৈলা দাশের বাড়ি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মিহির দাশগুপ্তের পরিবারের গভীর সমবেদনা। তারা এ গভীর শোক সামলে উঠুন, এটাই প্রার্থনা।

সর্বশেষ