শাকিব বিপ্লব:
সদ্য প্রয়াত বরিশাল জেলা মহিলা লীগের অন্যতম নেত্রী এবং বরিশাল জেলা রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ সাহান আরা বেগমের মৃত্যুর পর তার স্বামী কেন্দ্রীয় আ’লীগ নেতা ও পুত্র সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহসহ তার অপর দুই ভাই শোকগ্রস্ত। এমনকি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর আগৈলঝাড়ার সেরালস্থ বাস ভবন ও সাদিক আবদুল্লাহর কালীবাড়ি সড়কের নিজ বাসার চারপাশে পুলিশি বেষ্টুনি দিয়ে আগত দলীয় নেতাকর্মীসহ শুভাকাঙ্খিদের সাক্ষাতে পরোক্ষভাবে অপরগতা জানিয়ে দিয়েছে। উভয় বাড়ির সামনে গত দুদিন যাবত সাক্ষাত প্রার্থীদের ঢল নামলে পুলিশ বুঝিয়ে তাদের নিরুৎসাহিত করে স্থল ত্যাগে বাধ্য করছে।
দল ও পরিবার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের ভাষ্য হচ্ছে, গত শনিবার রাত ১১ টায় সাহান আরা বেগম হৃদরোগে আক্রান্ত আকস্মিক মৃত্যুতে গোটা পরিবার শোকে মুহ্যমান এবং ভেঙে পড়েছে। সাহান আরা বেগম ছিলেন ওই পরিবারের প্রাণভোমরা। পাশাপাশি স্বামী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও পুত্র বরিশাল নগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর রাজনৈতিক উপদেষ্টার ভূমিকায় নেপথ্যে থেকে কাজ করতেন। যে কারণে একাধারে অনেক গুনের অধিকারী এক দিকে রাজনীতিবিদ, অন্য দিকে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এই নারীর মৃত্যু শুধু আকস্মিকতায় নয়, অপত্যাশিত একটি ঘটনায় সেরনিয়াবাত পরিবারের মধ্যে শোকের মাতাম বইছে। কিন্তু কাউকে আঁচ করতে দিতে চাইছে না বলেই সকল প্রকার সাক্ষাত বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির চারেপাশে পুলিশের কড়া পাহাড়া বসানো হয়েছে।
অপর একটি সূত্র নিশ্চিত করে, সাহান আরা বেগম দীর্ঘ দিন ধরে জটিল রোগে ভুগছিলেন। গত শুক্রবার দুপুরে হঠাৎ বুকে ব্যাথা অনুভব করলে তাকে ঢাকা কলাবাগারের বাসা থেকে পিজি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেই সাথে সুস্থায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। তার অসুস্থ্যতা এবং মৃত্যুর খবর প্রচারে সেরনিয়াবাত পরিবার অতটা উৎসাহিত ছিলেন না, এমনটি দেখা গেছে, শোনাও গেছে। এমন কি সাহান আরা বেগম পিজিতে ভর্তি থাকাকালীন সেখানে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করলেও দলীয় কাউকেই প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তার জানাজা এবং দাফনকার্যে সর্ব সাধারণের অংশগ্রহন থেকে বিরত রেখে ছোট পরিসরে আয়োজন এবং সেরাল অথবা কালীবাড়ি সড়কে বর্তমানে সর্বধরনের দলীয় নেতাকর্মীদের আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং সাদিক আবদুল্লাহ দেখা না দেয়ায়। স্ত্রী এবং মায়ের মৃত্যুর পর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তার তিন সন্তান ঘরের ভিতরেই একাকি অবস্থান করছেন। নিশ্চিত হওয়া গেছে, দুই একজন দলীয় শুভাকাঙ্খির সাথে সেলফোনে যোগাযোগ রাখলেও সেই আলাপ বেশি দীর্ঘায়িত করছেন না।
এদিকে ধারণা করা হয়েছিল বরিশাল প্রেক্ষাপটে সাহান আরা বেগমের মৃত্যুতের খবরে জনতার ঢল নামবে। সেক্ষেত্রে দেখা গেলো ব্যতিক্রমতা। সম্ভবত আগেভাগেই পরিবার থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল তার মরদেহ বরিশালে পৌছানোর সাথে সাথে দাফনকার্য সম্পাদন করাসহ জানাজায় বেশি লোকের সমাগম যেনো না ঘটে। হয়েছেও তাই।
নগরীর মুসলিম গোরস্থান সংলগ্ন আঞ্জুমান মাঠে গত রবিবার সকাল ৮ টায় পূর্ব নির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী জানাজায় অংশ নিতে গেলে অগনতি নেতাকর্মী পুলিশ বাঁধার মুখে পরে।
সূত্র জানায়, সাহান আরা বেগমের দাফনকার্য শেষে কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ তার তিন সন্তানকে নিয়ে সরাসরি তার নিজ গ্রামের বাড়ি আগৈলঝাড়ায় চলে যান। অবশ্য পরে সাদিক আবদুল্লাহ কালিবাড়ি সড়কের বাস ভবনে ফিরে আসেন।
প্রশাসনিক একটি সূত্র জানায়, দুটি বাড়িতে যেনো কোন প্রকার লোক সমাগম না ঘটে এবং প্রবেশের সুযোগ না পায় সেধরণের গাইডলাইন দেয়ায় পুলিশি বেষ্টুনি কড়াকড়ি আরো আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু কে মানে কার কথা, বরিশাল আ’লীগের সুতিঘাগার সেরনিয়াবাত পরিবার সংগত কারণে জনপ্রিয়তার আলোকে এবং এই ক্ষমতার আমলে অগনিত শুভাকাঙ্খিরা এক নজর সাহান আরা বেগমের বিদায়পূর্ব মুখ দেখতে না পারায় আফসোস শোনা যায়। পরবর্তীতে শোকাহত পরিবারকে শান্তনা দিতে শুভাকাঙ্খিরা দুইটি বাড়ির আঙ্গিনায় গিয়ে পুলিশি বাঁধার মুখে হত্যাশ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
কি কারণে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ পরিবারের কর্তা হিসেবে এধরণের পদক্ষেপ নিলেন তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
তবে ঘনিষ্টজনরা বলছে, করোনা আতঙ্ক থেকেই এ ধরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারণ দশনার্থিদের সাক্ষাত সুযোগ দেয়া হলে একদিকে শোকে মুহ্যমান এ পরিবারকে নানা প্রশ্নে আরো হৃদয়ে আঘাত হানতে পারে, সেই সাথে রয়েছে কে করোনা ভাইরাস বহন করে আসতে পারে তা থেকে সতর্ক থাকতেই এমন ভাবনা থেকেই দূরত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
মূলত এ কারণেই সাহান আরা বেগম অসুস্থ অবস্থা থেকে মৃত্যু এবং সর্বপরি দাফনপূর্ব পর্যন্ত বেশ সতর্কতা অবলম্বন করার অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। অপর একটি সূত্র বলছে, সাহান আরা বেগম ৭০ বছরের দীর্ঘ এই জীবনের অর্ধাংশের অধিক প্রায় ৫০ বছরকাল আবুল হাসানাত আবদুল্লার জীবনসঙ্গি থেকে দাম্পত্য জীবনসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন দুর্যোগে তাকে সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের আগলে রাখতে ভূমিকায় বরাবরই অবর্তীন এই মহিয়াসী নারীর মৃত্যুতে বিশেষ করে বষিয়ান আ’লীগ নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ মানুষিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পরেছেন। স্বাভাবিকভাবেও কথা বলতে পারছেন না। অনুরূপ সাদিক আবদুল্লাহও ভেঙে পরেছেন। একজন যুব বয়সী ছেলে হিসেবে বরিশাল রাজনীতিতে পদার্পন এবং পর্যায়ক্রমে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে প্রথমে মেয়র পরবর্তীতে নগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এত সহসা অগ্রসর বা কাঙ্খিত স্থানে পৌছাতে মা সাহান আরা বেগমের অবদানই ছিল বেশি। অপর দুই পুত্র আশিক ও মঈন আব্দুল্লাহও রাজনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে মায়ের সান্নিধ্যে থেকে নানা পরামর্শ নিয়ে হয়েছেন সফল, কেউ অপেক্ষা ছিলেন রাজনীতির মাঠে পাকাপোক্ত অবস্থান গড়তে। এমতাবস্থায় মায়ের মৃত্যু আকাশ ভেঙে পড়ার ন্যায় সামিল বলে মনে করাটাই স্বাভাবিক হওয়ায় এই দুই পুত্রও এখন বাকরুদ্ধ।
অনেকের দাবি, সাহান আরা বেগমকে ত্যাগের প্রতীক হিসেবেই বলা যায়। ৭৫ এর কালো রাতে বড় পুত্র সুকান্ত বাবু বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারে হত্যার সেই দিনে এই কিশোরও প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, মা হয়েছিলেন প্রত্যাক্ষদর্শি। পরবর্তীতে স্বামী ও সন্তানদের রাজনীতিতে এত দুর নিয়ে আসায় তার দুরদর্শিতার মধ্যেও সেই ত্যাগ নিহিত ছিল বিধায় নিজেকে নিয়ে এক দন্ড ভাবেননি। বরিশাল থেকে ঢাকা আ’লীগ রাজনীতির সাথে জড়িত থেকেও অবদানের প্রতিদান চাইতে দেখা যায়নি বিধায় সাংসদ বা উপজেলা এমনকি জেলা পরিষদের চেয়ারে বসার মানষিকতা পোষন করেননি ত্যাগই এই জননী।
সংগত কারণে হাসানাত পরিবারে সাহান আরা বেগমের হঠাৎ এ ধরাধাম থেকে বিদায় নেয়ায় অপত্যাশিতভাবে এই বড় দুর্যোগ নেমে এসেছে, তা সেরনিয়াবাত পরিবার কিভাবে তা সামাল দেবেন বা শূণ্যতা পুরন করবেন, আগামীতে এ প্রশ্নের উত্তর মেলানোর অপেক্ষায় থাকতে হবে।