২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিভিন্ন সময়ে আল-কোরআনের পান্ডুলিপি সংরক্ষণ ব্যবস্থা

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোঃ আব্দুল ওহাব সাহেব খুলনার হুজুর (রহঃ) : মহা পবিত্র আল-কোরআন মহান আল্লাহতায়ালার বাণী এবং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, যা দয়াল নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। যাতে মানব জাতির জন্মলগ্ন থেকে কবর পর্যন্ত সর্বপ্রকার কল্যাণের দিকনির্দেশনা রয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় তথা একজন মানুষের এ ধরনীতে যত সমস্যা এবং যা যা প্রয়োজন, সবকিছুর সমাধান স্পষ্টভাবে এ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে, যা অন্য কোনো গ্রন্থে করা হয়নি। এ কোরআন দেড় হাজার বছর পূর্বে যেমনভাবে অবতীর্ণ হয়েছিল, ঠিক সেরূপ আজও বহাল রয়েছে, একটি বর্ণও পরিবর্তন হয়নি। তাই তো আজ শত শত বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন এটা পরম সত্য। এ গ্রন্থ কোনো দিন কেউ বিকৃত করতে পারবে না, কেননা এ গ্রন্থ সংরক্ষণ করার দায়িত্ব কোনো মানবের নয়; বরং এর দায়িত্ব স্বয়ং মহান আল্লাহতায়ালা নিয়েছেন। মহান আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, “এ গ্রন্থ আমি নাজিল করেছি এবং এর রক্ষক আমিই।” তদুপরি হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের সুবিধার্থে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোরআন শরিফ সংরক্ষণ করার দুটি উপায় গ্রহণ করেছিলেন। একটি হচ্ছে, যখন যে আয়াত অবতীর্ণ হয় তখনই সে আয়াত সাহাবিদের লিখে রাখার নির্দেশ দেন। তখনকার সময় কাগজ এবং মুদ্রণের ব্যবস্থা না থাকায় সাহাবিগণ পাথর, চামড়া ও পাতায় তা সংরক্ষণ করে রাখতেন। সর্বপ্রথম সাহাবিদের মধ্যে হযরত উম্মে খালিদ বিনতে খালিদ ইবনে সাইদ ইবনে আবিল আস (রা.) কোরআন লিখে সংরক্ষণ করেন, তারপর আরো বহু সাহাবি নিজ নিজ তত্ত¡াবধানে আলাদা আলাদা লিখে কোরআন সংরক্ষণ করেন।
দ্বিতীয় উপকরণটি হচ্ছে, হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবিদেরকে কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তা হিফজ করার আদেশ দেন এবং তিনি ঘোষণা করে দেন, যে ব্যক্তি কোরআনের আয়াত মুখস্থ করবে তাকে দোজখের আগুন স্পর্শ করবে না এবং আল্লাহতায়ালা তাকে কোনো শাস্তি দেবেন না। আরবি লোকদের স্মরণশক্তি খুব ভালো ছিল তাই হুজুর পাকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাণী শুনে হাজার হাজার সাহাবি উৎসাহিত হয়ে পুরো কোরআন শরিফ কণ্ঠস্থ করে ফেললেন।
প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অনুভব করলেন সমস্ত কোরআন একত্রিত করে একটি পান্ডুলিপি হিসেবে তৈরি করার। তাই তিনি বড় বড় সাহাবিদের পরামর্শক্রমে এমন সব সাহাবিকে এ কাজে নিয়োগ করলেন যারা এ কাজের যথোপযুক্ত এবং সবার নিকট নির্ভরযোগ্য। তাদের মধ্যে হযরত যায়েদ (রা.) ও হযরত উবাই বিন কাআব (রা.) ছিলেন দুর্লভ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। হযরত যায়েদ (রা.) ছিলেন ওহী লিপিকরণ বিভাগের ব্যবস্থাপক এবং কোরআনে হাফিজ। হযরত উবাইবিন কাআব (রা.) ছিলেন একজন বিখ্যাত ক্বারী এবং কোরআনের হাফিজ যার নিকট কোরআন শেখার জন্য হুজুরপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্য সাহাবিকে আদেশ দিতেন। হযরত আবু বকর (রা.)-এর তত্ত¡াবধানে হিজরী ১২ সালে আল কোরআনের পরিপূর্ণ পান্ডুলিপি সমাপ্ত করা হয় এবং এ পান্ডুলিপির নাম রাখা হয় “মাসহাফে-উম”। এ কপিটি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর নিকট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংরক্ষিত ছিল।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর তত্ত¡াবধানে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে যে, সমুদয় কোরআন সংকলন করা হয়, তাতে হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর অবদান সবচেয়ে বেশি। কেননা, তারই পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সমুদয় কোরআন একত্রকরণের কার্যে মনোনিবেশিত হয়েছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইন্তেকালের পর হযরত উমর ফারুক (রা.) খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। হযরত আবু বকর (রা.) কর্তৃক সংকলিত কোরআন “মাসহাফে-উম” তারই হাতে অর্পণ করা হয়। তিনি এ পান্ডুলিপির অসংখ্য কপি তৈরি করে দূর-দূরান্তে রাজ্যের আমির এবং জনগণের নিকট পাঠিয়ে দেন। তার শাসনামলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কোরআন মুখস্থ করেছিলেন এবং তিনিও সর্বপ্রথম হাফিজদের জন্য প্রতি বছর রমজান মাসে জামাতের সাথে খতমে তারাবি পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
সমগ্র বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ হযরত উসমান (রা.)-এর নিকট চির ঋণী। কেননা তিনি কোরআনের লিখিতরূপ সংরক্ষণের ব্যাপারে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিলেন। হযরত উসমান (রা.)-এর শাসন আমলে বহু দূর-দূরান্তে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল। লোকেরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই আল-কোরআন শিক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। তার শাসনামলে যেভাবে ইসলাম ধর্ম অতি দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছিল, তেমনিভাবে আল-কোরআনও সম্প্রসারণ লাভ করেছিল। কিন্তু অধিকাংশ নওমুসলিম ছিল অনারবি, তারা কোরআন সুস্পষ্টভাবে তেলাওয়াত করতে পারত না এবং অনেক আরবিরাও নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষায় কোরআন তেলাওয়াত করত অথচ কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে কোরাইশী ভাষায়। হযরত উসমান (রা.) দেখলেন, বিভিন্ন ভাষার কোরআন পড়ার দরুণ উম্মতের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হচ্ছে।
তাই তিনি সাহাবিদের পরামর্শক্রমে সমস্ত পান্ডুলিপি একত্রিত করে কোরাইশী লুগাতের পান্ডুলিপি ব্যতিরেকে অন্যান্য সব লেহাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সবাইকে কোরাইশী লেহাজে কোরাআন পড়ার আদেশ দেন এবং এ থেকে কপি তৈরি করে দূর-দূরান্ত রাজ্যে পাঠিয়ে দেন। এ জন্যই তাকে জমিউল কোরআন বলা হয়। হযরত উসমান (রা.) খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর সর্বপ্রথম পান্ডুলিপি ‘মাসহাফে-উম’ তার হাতে এসেছিল। তিনি এ থেকে নিজ হস্তে লিখে একখানা পান্ডুলিপি তৈরি করেন। এর নামকরণ করা হয়েছিল মাসহাফে উসমানী।
এটি এখানো তাসখন্দের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। হযরত উসমান (রা.) এ পান্ডুলিপি পাঠরত অবস্থায় বিদ্রোহীদের হাতে নিজ বাসভবনে শাহাদাতবরণ করেছিলেন।
হযরত আলী (রা.)-এর যুগে কোরাইশী ভাষায় পান্ডুলিপি বহু প্রচার এবং প্রসার লাভ করেছিল। তিনি নিজেও স্বহস্তে লিখে বহু পান্ডুলিপি তৈরি করেন। জানা যায়, তার স্বহস্তে লিখিত একখানা পান্ডুলিপি দিল্লির জামেয়া মিল্লিয়াতে সংরক্ষিত, অপর একটি দিল্লির জামে মসজিদে সংরক্ষিত আছে। হযরত আলী (রা.)-এর আপন দুই তনয়। ইমান হাছান ও হুসাইন (রা.) স্বহস্তে লিখিত দুখানা পান্ডুলিপি দিল্লির জামে মসজিদে সংরক্ষিত আছে। তাবেঈন ও তাবেতাবেঈনের যুগে কোরআন বহু প্রচার এবং প্রসার লাভ করেছে, যা গণনা করা সম্ভব নয়। তাদের থেকেই ক্রমাগতভাবে আমাদের নিকট কোরআন এসেছে। আগে মুদ্রণের ব্যবস্থা ছিল না, তাই তারা নিজ হস্তে কোরআন লিখতেন। আজ আমাদের মুদ্রণের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, তাই কোরআন সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসার আরও সহজ হয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ হাফেজদের বুকে সম্পূর্ণ কোরাআন তো উৎকীর্ণ আছেই।
লেখক : সাবেক মুফতি ও মুহাদ্দিস
নলছিটি সিনিয়র ফাজেল মাদ্রাসা, ঝালকাঠি।

সর্বশেষ