✒️আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোঃ আব্দুল ওহাব সাহেব খুলনার হুজুর (রহঃ)।
সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম শরিফে একটি হাদিস আছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ قَالَ,” أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا، أَوْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ الْأَرْبَعِ، كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا, إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ ”
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাদি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি কোনো ব্যক্তির মাঝে চারটি অভ্যাস জমা হয় তাহলে সে নিরেট মুনাফিক। কারো মাঝে এই চার অভ্যাসের কোনো একটি পাওয়া গেলে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মাঝে নেফাকের একটি অভ্যাস বিদ্যমান থাকবে। সেই চারটি অভ্যাস এই, যখন তার কাছে কোনো কিছুর আমানত রাখা হয়, সে খেয়ানত করে। যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে। যখন কোনো ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে। যখন কারো সঙ্গে ঝগড়া হয়, তখন গালাগালি করে। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)।
আলোচ্য হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি বদ অভ্যাসের কথা উল্লে খ করে। এবং এগুলো মুনাফিকের আলামত সাব্যস্ত করেছেন। কোনো মুসলমানের জন্য এ বদ অভ্যাসগুলোর কোনোটিই অবলম্বন করা উচিত না। যে ব্যক্তির মাঝে এসব বদ অভ্যাস জমা হবে, শব্দগত ও আইনি বিচারে তাকে মুসলমান বলা হলেও, কার্যত সে মুনাফিক।
চারটি অভ্যাসের প্রথমটি হলো, আমানতের খেয়ানত করা। খেয়ানতের একটি সুরত আমরা সবাই জানি। কোনো ব্যক্তি নিজের কোনো সম্পদ বা মাল কারো কাছে আমানত রাখল। তরপর সেই আমানত যত্নে সঙ্গে ফিরিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সে তা খরচ করে ফেলল। এটি খেয়ানতের সুস্পষ্ট ও নিকৃষ্ট সুরত। কিন্তু ইসলামি শিক্ষায় চিন্তা-ভাবনা করলে দেখা যায় যে, শুধু একেই খেয়ানত বলা হয় না। বরং খেয়ানতের আরো বহু সুরত আছে। উদাহরণত, শরীয়তসম্মত কোনো ওজর ব্যতীত কারো গোপন কথা ফাঁস করে দেয়াও খেয়ানত। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الْمَجَالِسُ بِالْأَمَانَةِ
‘মজলিসের বক্তব্য ও কথাবার্তা আমানত।’
কোনো মজলিসে যেসব কথাবার্তা হয় তা আপনার কাছে আমানত। মজলিসে সদস্যদের সম্মতি ও সন্তুষ্টি ছাড়া সেগুলো অন্য কারো কাছে বলা আমানতের খেয়ানত। কোনো মুসলমানের জন্য এটি জায়েজ নেই।
এমনিভাবে যখন কোনো ব্যক্তি কোথাও চাকরি করে, তার ডিউটির সময়গুলো তার কাছে আমানত। যদি তার ডিউটির সময় নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে ব্যক্তিগত কাজে সময় ব্যয় করে তা হলে শরীয়তের আলোকে এ ব্যক্তিও আমানতের খেয়ানত করছে। এই খেয়ানতকে অভ্যাস বানিয়ে নেয়া কোনো মুসলমানের কাজ না। বরং মুনাফিকের কাজ।
হাদিসের ভাষ্যমতে নেফাকের দ্বিতীয় আলামত মিথ্যা কথা বলা। কোরআন ও হাদিস এর খুব নিন্দা করা হয়েছে। ঈমান ও মিথ্যা দুটো সাংঘর্ষিক বিষয়। মুওয়াত্তা ইমাম মালেকে হজরত সাফওয়ান ইবনে সুলাইম (রাদি.) থেকে বর্ণিত আছে, জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, মুসলমান কি কাপুরুষ হতে পারে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। (মুসলমানের মধ্যে এই ত্রুটি থাকতে পারে)। এরপর জিজ্ঞাসা করেন, মুসলমান কি কৃপণ হতে পারে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। (মুসলমানের মাঝে এই ত্রুটি থাকতে পারে)। এরপর লোকটি জিজ্ঞাসা করেন, মুসলমান কি মিথ্যাবাদী হতে পারে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, না। (ঈমানের সঙ্গে মিথ্যার নাপাক অভ্যাস একত্র হতে পারে না)। (মুওয়াত্তা মালেক)।
অনেক সময় মিথ্যার প্রভাব ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে। অনেক সময় তার মিথ্যা বলার দ্বারা পুরা বংশের, আত্মীয়-স্বজনের, দেশের ও ধর্মের ক্ষতি হয়। প্রথম সুরতে একটি কবিরা গুনাহ হয়। কিন্তু দ্বিতীয় সুরতে অনেক সময় মিথ্যা কথা বলা হয় কেবল একবার। কিন্তু তা অনেক গুনাহর উৎসে পরিণত হয়। মিথ্যা কথা এত খারাপ যে, হাস্যরসের মাঝেও ইসলাম মিথ্যা কথা বলাকে সমর্থন করে না। সুতরাং চিন্তা করুন, সুস্থ অবস্থায় ও স্বজ্ঞানে মিথ্যা বলা ইসলামের দৃষ্টিতে কত ঘৃণিত ও মারাত্মক।
নেফাকের তৃতীয় আলামত ওয়াদা ভঙ্গ করা। এটি মুসলমানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মুসলমান একবার কোনো ওয়াদা করলে তা জীবন দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করে। এ জন্য যেকোনো ধরনের ক্ষতি বরদাশত করে। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বহু রয়েছে। মুসলমানরা শুধু অঙ্গীকার রক্ষার জন্য বড় বড় কোরবানি দিতেও পিছপা হননি। হজরত মুয়াবিয়া (রাদি.) শুধু অঙ্গীকার ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কায় একবার একটি বিশাল বিজিত এলাকা রোমানদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। (সুনানে তিরমিজি, সুনানে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)।
নেফাকের চতুর্থ আলামত হলো, কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ হলে গালাগালি করা। জীবনে বহু মানুষের সঙ্গেই মতবিরোধ হয়। কখনো কখনো তা ঝগড়া-বিবাদ পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু একজন প্রকৃত মুসলমানের কাজ হলো, বিবাদ ও বির্তকে ভদ্রতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা। দৃষ্টিভঙ্গিগত মতবিরোধ, রাজনৈতিক বিরোধ, ব্যবসায়িক কিংবা পারিবারিক বিরোধ, যেকোনো অবস্থায় গালাগালি করা, মুখ খারাপ করা মুসলমানের চরিত্র হতে পারে না।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে নেফাকের এসব বদঅভ্যাস থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ দাওড়ায় হাদিস, এম এম ডাবল (ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট)
গওহর ডাঙ্গা দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম, ফরিদপুর ও হাটহাজারী দারুলউলুম মুঈনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম।
কামিল (মাস্টার্স) হাদিস ও তাফসির
ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা।
সাবেক মুফতি ও মুহাদ্দিস
দেবিপুর সিনিয়র ফাজেল মাদ্রাসা, পিরোজপুর।
হদুয়া বৈশাখিয়া সিনিয়র ফাজেল মাদ্রাসা ও নলছিটি সিনিয়র ফাজেল মাদ্রাসা, ঝালকাঠি।