২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আব্বুকে ছাড়া রোজা ও ঈদ

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

আব্বু, কেমন আছেন? কত রমজান চলে গেলো আপনার কোনো খবর পাই না। আমার প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে আপনার কণ্ঠে ‘আব্বু’ শুনবো বলে! আব্বু, আমার ভালোবাসার সবকিছু! আমার সংগ্রাম, পথচলা, সফলতা- সবকিছুর মূলে ছিলেন আপনি।

আব্বুর স্বপ্নগুলো পূরণে অপ্রাপ্ত বয়সেই তো পরিবারের সবাইকে ছেড়ে ছুটেছি দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে! আমার চোখে আপনার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু কে জানে এমন হবে? আমাদের কথা একটু ভাবলেন না। হঠাৎ চলে গেলেন। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বেদনায় বুকটা ছিঁড়ে যায় আব্বু। আমি এখনো বিশ্বাস করি না যে, আপনি আমাদের মাঝে নেই।

আজ আমার দিন-রাত শুধু কান্নার এক বিশাল সমুদ্র বয়ে বেড়াচ্ছে। স্বপ্ন দেখার বয়স না পেরোতেই আমার জীবন স্বপ্নভঙ্গের হাহাকারে একাকার হয়ে আছে। সত্যি বলতে, আপনাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকাটা শুধুই সান্ত্বনার। আপনি চলে যাওয়ার পর থেকে আপনার স্মৃতিগুলো আমাকে একটি দিনের জন্যও স্বাভাবিক হতে দেয়নি। আমি কখনো স্বাভাবিক হতে পারবো না।
একটি একটি করে এবারের রমজানও প্রায় শেষ হতে চলল। ইফতারের আগে প্রতিদিন আপনার জন্য দোয়া করছি। আপনি থাকলে ফোন করে কী কী জিজ্ঞাসা করতেন? প্রতি রমজানের প্রতি সেহরিতে আপনি আমাকে ফোন দিয়ে জাগিয়ে দিতেন। প্রতি বছর বিশ রমজানের পর থেকে আপনি সবার ঈদের কেনাকাটার জন্য টাকা ভাগ করে দিতেন। আমি সবসময় সবার চেয়ে বেশি পেতাম। একমাত্র ছেলে বলেই হয়তো আপনার বেশি ভালোবাসা। আব্বু আপনি কেন আমাকে এতো ভালোবাসতেন? অথচ আমাকে ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার একটু সুযোগও দিলেন না। সারা জীবন আপনি চাকুরী করে আমাকে টাকা দিয়ে গেছেন। কোন কিছু বুঁজে ওঠার আগেই নিরবে অভিমান করে আমরা আপনার হতভাগ্য ছয়টি সন্তান আপনার কাছে পৌছার আগেই চলে গেলেন। শেষ বিদায়ের আগে আমাকে কি বলতে চেয়েছিলেন জানতে পারলামনা। আব্বু, এই কষ্ট নিয়েই আমার বাকি জীবন পার করতে হবে।

চার বছর আগে ঈদ আপনার সাথে করেছিলাম, এরপর থেকে আপনাকে ছাড়া একা একা ঈদ পালন করা। কত কেঁদেছি এখনো কাদছি, কিন্তু আর আপনার সাথে ইফতার করা, ঈদের নামাজ আদায় করা, ফজরের নামাজের পরে আত্মীয়-স্বজনদের কবর জিয়ারত করা, দুজনে কথা বলতে বলতে ঈদের মাঠে যাওয়া আমার আর সারা জীবনেও আসবে না।

আব্বু, আপনি বাজারে নিয়ে গেলে ছোটবেলায় আমার সব আব্দার পূরণ করতেন। আমার যা ইচ্ছে হতো কিনে দিতেন। রাতে বাড়ি ফিরে আমি যখন ঘুমিয়ে পড়তাম; আমার পছন্দের জিনিসগুলো কিনে এনে আমার বিছানার পাশে রাখতেন। আমি ছোটবেলায় আপনাকে ছাড়া ঘুমাতাম না। আপনিও ঘুমাতেন না। আপনার কর্মস্থল থেকে বাড়িতে গেলে আমার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতেন কখন বরিশাল থেকে বাড়িতে যাব। মোবাইল হাতে নিয়ে সামনের সিঁড়িতে বসে থাকতেন আর তাকিয়ে থাকতেন, একটু পরপর মোবাইলে কল দিয়ে খোজ নিতেন কতদূর আসছি, কিভাবে আসতেছি, কোন গাড়িতে আসতেছি, পথে আবার কোন সমস্যায় পড়লাম কিনা, আমি কখন আপনার সামনে হাজির হবো। দুর থেকে দেখলেই খুশিতে আম্মুকে বলতেন ওগো আব্বু চলে আসছে, আমার কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিতেন, আপনার পুত্র বধু ও দাদুভাইয়ার খোজ নিতেন। পাখাটা হাতে নিয়ে বাতাস দিতেন। আব্বু জানেন? আজ কেহ বাড়িতে যেতে বলেনা, কেহ সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করেনা, বার বার কল দিয়ে বলেনা আব্বু কতদূর আসছ?

বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে যখন চাকুরীতে যোগদান করি, তখন থেকে বুঝতে পারলাম রোজা, ঈদ মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবাদের জন্য আনন্দের পাশাপাশি কতটা ভাবনার। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে তারা কত ত্যাগই না করে! বুঝতে পারলাম আব্বু আমাদের সবাইকে নতুন জামা কাপড় কিনে দিয়ে নিজে কিনতেন না কিছুই। চোখে পড়তে থাকলো আব্বুর সেলাই করা পুরনো জুতা, পুরনো পাঞ্জাবিকে ধুয়ে নীল দিয়ে ইস্ত্রি করে ঈদগাহে যাওয়া । কিছু লাগবে আমাদের আর আব্বু না বলেছেন, এমন কোনোদিন হয়নি। হাসিমুখে সব দিয়েছেন। আব্বু, আপনি আমাকে এতটা ভালোবাসতেন যে মৃত্যুর আগেও আপনার জীবনের সর্বশেষ আপনার সেই মাসের বেতনের চেকটিতেও আপনি টাকার অঙ্ক লিখে স্বাক্ষর দিয়ে রেখেগেছেন যাতে আপনার ছেলের আপনার বেতনের টাকাটা উঠাতে কষ্ট না হয়। আপনার পেনশনের টাকাটা যাতে কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়া তুলতে পারি সেজন্য সব কাগজপত্র আপনি রেডি করে রেখে গেছেন। আব্বু, আপনার এ ভালোবাসার মুল্য দিব কি দিয়ে? এই হতভাগারতো কোন যোগ্যতাই নেই।

সময় সব ভুলিয়ে দেয়। বাস্তবতার আঘাতে, সব সময় আব্বুকে মনে করা হয় না ঠিকই। তোমার আব্বু মারা গেছে কত বছর?—এ প্রশ্নের জবাব হয়তো একটু ভেবে, হিসাব করেই দিতে হয়,কিন্তু আব্বু নেই। এ কঠিন সত্যিটার মুখোমুখি প্রতিদিন হতে হয়। হতে হবে যতদিন বেঁচে থাকব। ইফতার করতে বসলেই মনে পড়ে সেই আব্বুর তুলতুলে কোমল হাত দিয়ে মুড়ি মাখানো, ইফতারের আগে আব্বু বাসার সবাইকে ডেকে ইফতারি সামনে নিয়ে বসা এবং দোয়া করা। ঝালকাঠিতে এবং টেকেহাট বাজারে ঈদের কেনাকাটা করতে যাওয়া, সেই দোকানগুলোর সামনে পড়লে, আমাকে বেসামাল করে দেয়। নিজেকে লুকাতে চাই নিজের থেকে, পারি না। বুকে বিঁধে থাকে সেই সেলাই করা আব্বুর পুরনো জুতো এবং জামা!

আব্বু, আমি এখনো আপনার পথ চেয়ে থাকি। আপনি আমার মোবাইলে কল দিবেন। রাতে ঘুমাতে পারি না একা একা কাঁদতে থাকতি। আবারো আপনার আঙুল ধরে হাঁটতে চাই। আপনার সাথে হেটে মসজিদে যেতে চাই, আপনার সাথে ঈদের মাঠে গিয়ে আপনার পিছনে নামাজ আদায় করতে চাই। একবার ফিরে আসেন আব্বু! সবাইকে বলে দেন- আমারও মাথার ওপর বিশাল আকাশ আছে। আমারও আব্বু আছে।

হে আরশের মালিক আপনার কাছে জোর আপিল, পবিত্র মাহে রমজানে আমার রাখা রোজা ও তারাবির নামাজের উছিলায় আপনার “রহমতের চাদরে আবৃত করেন আমার আব্বুর পরকালীন জীবন। মাগফেরাতের ছোয়ায় পুলকিত করেন আমার আব্বুর জীবনের সকল ভুলত্রুটি। আমার আব্বুকে আপনার জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করেন, আমিন।

✒️ মুহাম্মাদ ইমাদুল হক ফিরদাউছ (প্রিন্স)
ডেপুটি রেজিস্ট্রার (গ্রেড-৫)
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ