জুবাইয়া বিন্তে কবির (জুবা)
শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়ের মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে অবস্থান করছি আমরা। ইন্টারমিডিয়েটতো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এবারশেষ/ ৮ম সেমিস্টারের পরিক্ষার মাধ্যমে অনার্স লাইফেরও ইতি ঘটতে যাচ্ছে। সময় এত দ্রুত চলে গেলো! ভাবতেই কেমন আবেগী হয়ে যাচ্ছি।
মনে হচ্ছে এইতো সেদিন ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিয়েছি। অথচ আজ চার বছর। ছেড়ে যাওয়াও সময় হয়েছে। পুরাতন খাতাগুলো খুলে দেখলাম প্রথম সেমিস্টারে আমাদের প্রথম ক্লাসটা (ওরিয়েন্টেশন) নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এএইচএম আক্তারুল ইসলাম জিল্লু স্যার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস এত বেশি আবেগ আর উচ্ছ্বলতা ছিল, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আজও ঠিক মনে আছে, তিনি পড়িয়েছিলেন ইকোনোমিক্সর ব্যাসিক পার্টগুলো এবং অর্থনীতি পড়ে আমাদের অর্জিত জ্ঞান যেকোনো ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবো। তিনি বলেছিলেন হতে পারবে তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হতে পারো গবেষক, হতে পারো বহুজাতিক কোম্পানির ডিরেক্টর, হতে পারো আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, হতে পারো সমাজকর্মী, কিংবা হয়ে যেতে পারো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর!
ওরিযেন্টেশনে জনাব মোঃ আরিফুল ইসলাম আরিফ স্যার তার লেকচারে বলেছিলেন অর্থনীতি অনেক প্রসারিত একটি বিষয়। তোমরা খেয়াল করলেই দেখবে স্টক মার্কেট থেকে শুরু করে বাড়ির পাশে ছোট বাজার কিংবা জাতীয় বাজেট থেকে শুরু করে ঘরের আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি। আমরা সবাই প্রতিদিনই অসংখ্য অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিই, পার্থক্য শুধু আমরা জানিই না সেগুলো যে অর্থনীতির পাঠ্য। মোটকথা আমাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই অর্থনীতি বিদ্যমান।
নবীন বরণ অনুষ্ঠানে জনাব মোঃ মুসফিকুর রহমান স্যার তার বক্তব্যে বলেছিলেন, অর্থনীতি বিশ্ব কীভাবে পরিচালিত হয়- এই বিষয়ক ধারণা পেতে সাহায্য করে। কোন সামগ্রীর দাম নির্ধারণ করা থেকে শুরু করে একটি দেশে অর্থনৈতিক অসাম্য বিরাজ করার কারণ সবকিছুই শেখানো হয় অর্থনীতি বিষয়ে।
সমাজ ব্যবস্থা , রাষ্ট্রনীতি, আন্তজার্তিক ও দেশী বাজার, পুঁজিবাজার, রাজনৈতিক ব্যবস্থা সবকিছুই আপনি বুঝে উঠতে পারবে অর্থনীতির বিভিন্ন থিওরী ও মডেলের সাহায্যে। আমরা আমাদের নিত্যজীবনে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি তা সবই ওতপ্রোতভাবে অর্থনীতির সাথে জড়িত। বাস্তব জীবনের এসব ঘটনা, যেগুলোকে Real Life Example বলা চলে, সেগুলোর দিকে তাকালেও অর্থনীতির মাহাত্ম্যটা টের পাওয়া যায়।
তিনি উদাহরণস্বরুপ বলেছিলেন, সম্পদ কতোটুকু আছে সে অনুযায়ী আমরা কতোটুকু ভোগ করবো সেটার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে কতটুকু ব্যয় করা হবে- সবই অর্থনীতির সাথে জড়িত এবং অর্থনীতি পড়ার মাধ্যম্যেই আমরা এগুলো বুঝে উঠতে পারবো।
অর্থনীতিতে পড়ে টাইমস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের কাছ থেকে চার বছরে আমরা বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে অর্থনীতি জ্ঞান প্রগাঢ় করার চেষ্টা করেছি। প্রথম ও ২য় সেমিস্টারে মাইক্রো ইকোনমিক্স এবং ম্যাক্রো ইকোনমিক্স নিয়ে সাধারণ ধারণাটা পেয়েছি, সাথে শিখেছি গণিত আর পরিসংখ্যানও। ৩য় ও ৪র্থ সেমিস্টারে মাইক্রো আর ম্যাক্রোর পাশাপাশি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নিয়েছিলাম সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়কে। ঐচ্ছিক হিসেবে শিখেছি সফটওয়্যার ও এর উচ্চতর প্রয়োগগুলোও!
৫ম থেকে ৮ম সেমিস্টারে আমাদের সাথে পরিচয় হয় ইকোনমেট্রিক্সের- অর্থনীতি নামক ঘোড়ায় সওয়ার হলে যে জিনিসটি বাকি জীবন কাজে লাগবে সে বিষয়ে। এছাড়াও ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স, পাবলিক ইকোনমিক্স, মানিটারি ইকোনমিক্স, লেবার ইকোনমিক্সের মতো অর্থনীতির উচ্চতর বিষয়গুলো নিয়েও পড়তে হয়েছে আমাদের।
করোনার সময়ে প্রায় দুই বছর যাবত অনলাইনে ক্লাস করছি। তবে করোনার পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বাকি ক্লাসগুলো বন্ধুদের সাথে আড্ডা/ঘুড়াঘুড়ি করে সেই আনন্দে কাটিয়েছি।
এখন আমাদের ৮ম সেমিস্টার (ফাইনাল) পরীক্ষা শেষে শত চেষ্টা করলেও আর কোনো দিন আড্ডা-ঘোরাঘুরি সম্ভব হবে না। পাশাপাশি একত্রে বসে কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার ম্যাডামদের কোনো ক্লাস করতে পারবো না। পারবো না বন্ধুদের সাথে ক্লাসে বসে দুষ্টুমি করতে। ক্লাসের প্রথম সিটটা সবসময় আমার দখলে থাকতো। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মোবাইলে বন্ধুদের দুষ্টুমি করার ছবি তোলা কিংবা অদ্ভুদ ধরনের এডিট করে সবাইকে হাসানো, এই সব কিছুই একসময় হয়ে যাবে স্মৃতি। কোনোটাই আর হয়ে উঠবে না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার যন্ত্রণা থাকবে না, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্লাস। দেড়িতে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য স্যার-ম্যাডামদের ধমক খাওয়া। আমার বরিশালের বাসা থেকে রাতে পড়াশুনা করে সেই ভোরে সন্তানদের রেডি করে রওয়ানা দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা, পরীক্ষার আগে টেনশন প্রশ্ন কমন পড়বে কিনা, উত্তরগুলো সব পারব কিনা এসব কিছুই হয়ে উঠবে এখন শুধুই স্মৃতি।
বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো চার বছরের রঙিন সময়গুলো সব এখন স্মৃতিময়। ডিপার্টমেন্ট থেকে বনভোজনের উদ্দেশ্যে বাসে চড়ে চিৎকার করতে করতে যাওয়া, কখনো দল বেধে ঘুড়তে যাওয়া আর কোনো দিন হবে না। জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না, সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে এক সময় পৌছায়। হেঁটে যাই জীবনের একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তের দিকে ক্রমশ, ক্রমাগতভাবে অনন্তের দিকে। হয়তো আমাদের সমাজ জীবনে ও ব্যক্তিজীবনে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসবে, কিন্তু বন্ধুদের ঘিরে কিংবা ক্যাম্পাসের এই স্মৃতিমধুর সময়গুলো আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
চার বছরের বন্ধুত্ব টিকে থাকুক আজীবন। কর্মজীবন এবং পারিবারিক ব্যস্ততার মাঝেও যেন বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন না হয়, এমনটিই প্রত্যাশা।
🖋️লেখক:- জুবাইয়া বিন্তে কবির
শিক্ষার্থী
অর্থনীতি বিভাগ, টাইমস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ।