৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চিকিৎসা পেশাজীবীদের সাপ্তাহিক ছুটি দু’দিন করা জরুরী

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

বাণী ডেস্ক: চিকিৎসা পেশা একটি সীমাহীন চাপের পেশা। প্রতিদিনের দায়িত্বের পাশাপাশি জাতীয় যে কোনো স্বাস্থ্য দুর্যোগে এ পেশায় নিয়োজিতদের সম্পৃক্ততা অনিবার্য। এতো চাপের পরও দেশে চিকিৎসকদের সাপ্তাহিক ছুটি একদিন, যা বিশ্বের কোথাও নেই। এ কারণে পড়াশোনা, গবেষণা, ব্যক্তিগত কাজ কিংবা পরিবারকে সময় দেয়া—কোনোটাই ঠিক মতো হয় না তাঁদের।
এমনই প্রেক্ষাপটে চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশাজীবীদের সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি কেন জরুরি এর কিছু যৌক্তিকতা তুলে ধরছি।
১. প্রথমত পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে স্বাস্থ্য পেশার সাথে সংযুক্ত সবার জন্য সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি প্রচলিত। চিকিৎসার মতো একটি স্ট্রেসফুল পেশায় কর্মরতদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টির সাথে জড়িত। চিকিৎসকরা কোথাও একদিন ছুটি পান, অন্য দেশে এ রকম কোনো উদাহরণ আমার জানা নেই।
২. বিগত এক দশকে বাংলাদেশে যতজন চিকিৎসক বের হয়েছেন, তাদের দুই তৃতীয়াংশই নারী। পেশার বাইরেও তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন, ছোট ছোট সন্তান রয়েছে। আবার বিপরীতে পুরুষ চিকিৎসকদের অলমোস্ট সবাই নারী চিকিৎসক বিয়ে করার দরুন, তারা উভয়েই কর্মস্থলে থাকছেন। পর্যাপ্ত পারিবারিক সময় না পাবার কারণে পারিবারিক দ্বন্দ্ব বাড়ছে এবং পেশা হিসেবে চিকিৎসকদের মাঝে ভয়ানকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা সন্তানরা বঞ্চিত হচ্ছেন। সপ্তাহে একদিন ছুটিতে নিজ গৃহের বাইরে যাবারও অবকাশ নেই। দিনের পর দিন, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত চিকিৎসক কখনই সেবাপরায়ণ হতে পারবেন না।
৩. বিগত এক দশকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চিকিৎসক সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন এবং মোটামুটি সবাইকেই উপজেলা পর্যায়ের কর্মস্থলে থাকতে হয়। বেশিরভাগ পুরুষ চিকিৎসকদের পরিবার শহরাঞ্চলে বা দূরে থাকেন। সাপ্তাহিক ছুটি একদিন হলে নৈমিত্তিক ছুটি নেয়া ছাড়া দূরের কর্মস্থল থেকে কীভাবে সাপ্তাহিকভাবে একটি সামাজিক জীবন পরিচালনা করা সম্ভব?
৪. বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে চিকুনগুনিয়া, ২০১৯ সালে ভয়ানক ডেঙ্গু, ২০২০-২০২২ তিনবছর টানা কোভিড এবং এর পরে ২০২৩ আবার ডেঙ্গুর ক্রমাগত চিকিৎসা প্রদানে নিসন্দেহে চিকিৎসকরা মনস্তাত্ত্বিক চাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। কোন পেশাতেই টানা স্ট্রেস যৌক্তিক নয়। এমনকি যুদ্ধরত সেনাবাহিনীতেও নেই।
৫. প্রতিটি জেলা শহরে ট্রাফিক জ্যামের কারণে শহরের ভেতরে এবং এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া একটি ভয়ানক হয়রানির বিষয়। ঢাকা শহরে রাস্তায় তিন চার ঘণ্টা চলে যায়। এক্ষেত্রে কর্মদিবসের কষ্টটুকু পুষিয়ে নেয়ার জন্য শারীরিক প্রয়োজনেই দুদিন ছুটি দরকার। আমি বলবো অনেক চিকিৎসক সেলুনে যাবার জন্যও সময় পান না।
৬. সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি থাকলে আমি দৃঢ়চিত্তে বলবো, চিকিৎসকদের অনুমোদিত কর্মস্থলে অনুপস্থিতির হার অবশ্যই হ্রাস পাবে। কারণ সে বৈধভাবেই দুদিন ছুটি পাবেন। এমনকি সময়ের আগেই কর্মস্থল ত্যাগ কমবে। সুতরাং কাজের প্রতি প্রতিশ্রুতি বাড়বে।
৭. সপ্তাহে পাঁচদিন হলে চিকিৎসকদের হাসপাতাল সময় ৮-৪টা বা ৯-৫টা অবধি চলবে। আলাদা করে ইভিনিং সার্ভিস চালুর প্রয়োজন নেই। সরকারের ব্যবস্থাপনা বোঝা লাঘব হবে। অপরদিকে সকল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইভিনিং সেবা চলবে।
৮. দুদিন ছুটি হলে শুধুমাত্র আউটডোরটাই বন্ধ থাকছে। মনে রাখতে হবে, আউটডোরে কোন ইমার্জেন্সি রোগী দেখা হয় না। কিন্তু ৮-৪টা বা ৯-৫টা খোলা থাকলে গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও মহিলারা সকালের কার্যক্রম সমাপ্ত করে এমনকি দুপুরে খেয়ে এসেও চিকিৎসককে দেখাতে পারবেন। হাসপাতালে দূরের রোগীদের অনেকেই সকালে এসে, জরুরি রিপোর্ট থাকলে একই দিনে দেখানোর সুযোগ পাবেন। এতে রোগীদের হয়রানিও অনেকাংশে কমে যাবে।
৯. টানা ৬ দিন আউটডোরে শত রোগী দেখা টক্সিক ও প্রাণঘাতী। মানবিকতার নামে এক ধরনের অমানবিকতা চলছে যুগের পর যুগ। আর রোগীদের কোন ডায়ানোসিস নয়, ওষুধ লেখা হচ্ছে। তারপরেও চিকিৎসক সংকটের কারণে সামাধান না হওয়া অবধি করতেই হবে। বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ সপ্তাহে দুদিন ছুটি হলে নৈমিত্তিক ও স্বাস্থ্যগত ছুটি নেয়ার হার কমবে।
১০. সমবিচার ও সমান অধিকারের যুক্তিতেও অন্যান্য চাকরিজীবী ও পেশাজীবীরা দুদিন ছুটি পেলে চিকিৎসকরা কেন পাবেন না? তারা তো অসীম ক্ষমতার দানব বা দেবতা কোনোটাই নন। দুদিন ছুটি হলে তারাও উদ্যোমী হবেন ও হাসপাতালে টোটাল হিসাবেও অতিরিক্ত সময় সেবাদানের সম্ভাবনা বাড়বে।
১১. খোলা থাকার বাকি ৫ দিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাসপাতালে উপস্থিত থাকলে রোগীরাও উপকৃত হবেন। তারা সময় নিয়ে রাউন্ড দেবেন। অপারেশনের দিনে অপারেশনের সংখ্যা বেড়ে যাবে। ইমার্জেন্সি ও ইনডোর সব সময় সব রোগীদের জন্য সপ্তাহে ৭ দিনই ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। ইমার্জেন্সি ও ইনডোর ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞদের জন্য রোস্টারভিত্তিক নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার ডিউটি থাকবে। বাকি দিন তাদের ডে অফ (ছুটি) দেয়া হউক।
১২. বাংলাদেশের চিকিৎসকদের বড় সংকট হচ্ছে আপডেটেট না থাকা, গবেষণা বিমুখতা। একদিন বাড়তি ছুটি তাকে নিজের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা, নতুন তথ্য জানা, গবেষণামূলক কাজের জন্য সময় দেবেন। এতে মেকেল সেক্টরে কোয়ালিটি সেবার মান নিঃসন্দেহে বাড়বে।
১৩. বাংলাদেশের চিকিৎসা পেশায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস একটি কালচার। এটি নিয়ে নেগেটিভ আলোচনা পুরোটাই পদ্ধতি বা পরিচালনাগত। যেমন: অফিস টাইমে রোগী দেখা বা কর্মস্থলে না থাকা কিংবা স্বল্প সময়ে বেশি রোগী দেখা। কিন্তু এ স্বল্প বিশেষজ্ঞের দেশে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের বাইরে রোগীদের পেশাগত সেবা দেয়া দেশের কল্যাণ ব্যতিত কোনো অকল্যাণ নেই। এমনকি যেসব চিকিৎসক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ জেলার বাইরে কাজ করেন, তারাও একই সেবায় আছেন। এতে রাজধানীতে চাপ কমছে এবং রোগীর দূরে গিয়ে চিকিৎসায় হয়রানি বা আর্থিক সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু এতে চিকিৎসকরা বাড়তি স্ট্রেসে থাকছেন। প্রয়োজনে অতিরিক্ত ছুটির দিনটিতে ‘নো প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ নিয়ম করুন।
চিকিৎসকদের বলবো, মানুষ একটি মানবিক প্রাণী, ভারবাহী নয়। দয়া করে ডায়াগনস্টিকের চাহিদা মেটাতে গিয়ে মানি আর্নিং মেশিনে পরিণত হবেন না। দুয়ারে দুয়ারে ছুটবেন না। মনে রাখবেন, আপনি চাইলে ২৪ ঘণ্টাও আয় করতে পারেন। আমরা প্রচুর চিকিৎসক হৃদরোগ ও হাইপারটেনশন ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছি। পেশার বাইরেও মানুষের ব্যক্তিগত ও সুস্থতাপূর্ণ জীবন আছে। তাই সকল যুক্তিতে সম্মানিত কর্তৃপক্ষের কাছে দুদিন ছুটির বিষয়টি সময়োপযোগী ও একান্তই মানবিক চাওয়া।

লেখক:
ডা. মুহিব্বুর রহমান রাফে
ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ

সর্বশেষ