মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বরিশাল জেলায় বামপন্থীদের ভূমিকা

প্রকাশের তারিখ: ডিসেম্বর ৮, ২০২০ | ১:১০ পূর্বাহ্ণ
শেখ রিয়াদ মুহাম্মদ নুর : নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দান করলেও সেই যুদ্ধে বামপন্থী ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে তাদের সেই ভূমিকাকে অস্বীকার করার একটি অশুভ তৎপরতা দেখা যায়। বিশেষ করে চীনপন্থী বামদের বিরুদ্ধে অজ্ঞতাপ্রসূত প্রচারণা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রপাগাণ্ডা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। যদিও এক্ষেত্রে বামপন্থীদের দায়ও রয়েছে। মোহাম্মদ তোয়াহা’র ‘কৃষক বিপ্লব’ দ্বারা যারা পরিচালিত হয়েছিলেন তাদের একটি অংশ খুলনা-যশোর অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে অসম সাহসী লড়াই করেছিলেন। এদের একটি অংশ মুজিবনগর সরকারের প্রতি অনুগত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কোনোরকম সংঘাতে না জড়িয়ে নোয়াখালীর চর এলাকায় মুক্ত অঞ্চল গঠন করে ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে জমি বিতরণ করেছিলো। কিন্তু একপর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতি অনুগত মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কোনো অংশের  আক্রমণাত্মক তৎপরতায় কোনঠাসা হয়ে মোহাম্মদ তোয়াহা’র অনুগত বামপন্থীরা মুক্তিসংগ্রামে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে অপারগ হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ‘দুই কুকুরে কামড়া কামড়ি’র তত্ত্ব দিলেও আবদুল হক ও তার অনুসারী বামপন্থীরা একাত্তরের জুন মাসের দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অপরদিকে মাওলানা ভাসানীকে প্রধান নেতা মেনে নিয়ে কাজী জাফর আহমেদ-এর নেতৃত্বে ১৯৬৭ সাল থেকে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করে একদল চীনপন্থী বিপ্লবী রাজনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা দেশে আসার পূর্ব পর্যন্ত এরাই ছিলো রণাঙ্গনের মূল চালিকাশক্তি। এদের পাশাপাশি সিরাজ সিকদার-এর নেতৃত্বে একদল বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা তুমুল  লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় পর্যায়ের বামপন্থী নেতাদের ভূমিকা যেমন উহ্য রাখার প্রবনতা রয়েছে তেমনি মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকা আলোচনার বাইরে রাখা হয়। এই প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বরিশাল জেলায় বামপন্থীদের ভূমিকার একটি সংক্ষিপ্ত দৃশ্যপট তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংকের টাকা নিয়ে নেয়ার অসর্মথিত অভিযোগ থাকলেও বরিশাল অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধকে সার্বজনীন রূপ দিয়েছিলেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় পরিষদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনজুর। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে দল-মতের উর্ধ্বে ওঠে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাকে বাদ দিয়ে বরিশালের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লেখা অসম্ভব। তিনি একাত্তরের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা হোসেন সেন্টু’র মাধ্যমে তৎকালীন বরিশাল জেলা ভাসানী ন্যাপ-এর সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল হোসেন ফোরকান’কে নিজ বাসায় ডেকে এনে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বামপন্থী ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহবান জানান। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সকলের সাথে ঐক্য স্থাপন করার বামপন্থিদের পূর্ব সিদ্ধান্ত থাকায় নুরুল ইসলাম মনজুর-এর প্রস্তাবে ইকবাল হোসেন ফোরকান তাৎক্ষণিক সম্মতি প্রকাশ করেন। এরপর গভীর রাতে সদর রোডস্থ ভাসানী ন্যাপ কার্যালয়ে কেরামত আলী সরদার, সামসুদ্দিন মানিক, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শাহ আলম খান, ইকবাল হোসেন ফোরকান সহ ভাসানী ন্যাপ ও ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি’ এবং বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন।
২৬ মার্চ সকালে পুলিশ সুপারের সরকারি বাসভবনে বরিশাল শহরে অবস্থানরত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যসহ সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মী ও জেলা প্রশাসনের সকল বিভাগের প্রধানরা সভা করেন। সেই সভায় বামপন্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে বরিশাল জেলা ভাসানী ন্যাপ-এর সভাপতি এন আই খান, সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল হোসেন ফোরকান, জেলা কমিটির সদস্য সামসুদ্দিন মানিক ও ভাষা সৈনিক আবুল হাশেম উপস্থিত ছিলেন।
২৬ মার্চ বিকেলে দোয়ারিকা ও শিকারপুর ফেরিঘাট পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত রাখতে এবং ওই পথ দিয়ে হানাদার বাহিনীর বরিশাল শহরে প্রবেশ প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইকবাল হোসেন ফোরকান-এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রেরণ করা হয় এবং ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় পুলিশ লাইনস থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র থেকে ১১টি থ্রী-নট-থ্রী রাইফেল ও ১টি ব্যারেটা গান ইকবাল হোসেন ফোরকান-এর হাতে তুলে দেন নুরুল ইসলাম মনজুর। সেই দলটি বামপন্থী ও  অরাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। তারা রহমতপুর এয়ারপোর্টে ঘাঁটি স্থাপন করেন। ইকবাল হোসেন ফোরকান ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দলে বামপন্থীদের মধ্যে ছিলেন, কেরামত আলী সরদার, মজিবর রহমান চাঁন, খোন্দকার আনোয়ার হোসেন, আব্দুল জব্বার, মোসলেম, ছুট্টু, শাজাহান মাস্তান, বাবু লাল, প্রমুখ। অন্যদিকে অরাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শুক্কুর ব্যাপারী, সুলতান আলম মজনু, শাজাহান হাওলাদার, কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক, সচীন কর্মকার, মোস্তফা শাহাবুদ্দিন রেজা, রফিকুল ইসলাম নান্নু, বাহাদুর আনসারী, রফিকুল ইসলাম, জিয়াউর প্রমুখ।
২৭ মার্চ বিকেলে বাবুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি আতাহার দারোগা, আব্দুল ওহাব খান, আব্দুস সালাম ও জিয়াউল করিম বাদশা সহ বিপুল সংখ্যক স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দলের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ দেখান। এর প্রেক্ষিতে বাবুগঞ্জ থানায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য কাঠামোগত রূপরেখা প্রণয়ন করে আতাহার দারোগা’কে উপদেষ্টা, ইকবাল হোসেন ফোরকান’কে কমান্ডার, আব্দুল ওহাব খান’কে ডিপুটি কমান্ডার এবং সুবেদার মোঃ আলী’কে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে নুরুল ইসলাম মনজুর এই দলের কার্যক্রম গতিশীল করতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ থেকে পর্যায়ক্রমে একটি ভেসপা মোটরসাইকেল ও সাদা রং-এর একটি উইলি জীপ গাড়ীর ব্যবস্থা করে দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ক্যাম্পে এপ্রিলের শুরুর দিকে একটি কৌতুক উদ্দীপক ঘটনা ঘটেছিল। বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম-এর টাকা চুরি করে ধরা পড়ে যান সচীন কর্মকার। আবদুল ওহাব খান-এর নেতৃত্বে এই ঘটনার বিচারের উদ্যোগ নেয়া হলে সচীন কর্মকার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সরাসরি ভারতে চলে যান। সেখানে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ক্যাপ্টেন সচীন কর্মকার নামে পরিচিতি লাভ করেন।
যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল নির্ধারণে মতদ্বৈততার কারণে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বরিশাল শহরের ল’ কলেজে বামপন্থীদের আলাদা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। তা সত্ত্বেও এই ক্যাম্প প্রতিষ্ঠায় নুরুল ইসলাম মনজুর অর্থ ও খাদ্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করে সহায়তা করেন। ল’ কলেজ ক্যাম্পেরও সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন ইকবাল হোসেন ফোরকান। ১২ এপ্রিলের পর এয়ারপোর্ট ক্যাম্প থেকে অধিকাংশ বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা পর্যায়ক্রমে ল’ কলেজ ক্যাম্পে চলে আসলে হাবিলদার মজিদ এয়ারপোর্ট ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ সহ আনুসাংগিক  দায়িত্ব পালন করেন। বরিশালের অন্যান্য বামপন্থীরাও ল’ কলেজ ক্যাম্পে যোগদান করেন। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ল’ কলেজ ক্যাম্প কার্যকর ছিল। এই ক্যাম্প থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বল্পমেয়াদী বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। তাছাড়া মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চিনের বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী কেরামত আলী সরদার-এর নিজের করা ডিজাইনে শহরের রিফুজি কলোনি থেকে প্রচুর পরিমাণে হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি করে এখানে মজুদ এবং বামপন্থীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। এই ক্যাম্পের সাথে আরও যুক্ত ছিলেন, ভাসানী ন্যাপ সভাপতি এন আই খান, সহসভাপতি সুনীল গুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. সিদ্দিক হোসেন, জেলা কমিটির সদস্য সামসুদ্দিন মানিক, ভাষা সৈনিক আবুল হাশেম, ভাষা সৈনিক আব্দুল মোতালেব মাস্টার, এ্যাড. শাহ আলম খান, এএইচএম সালেহ, বিএম কলেজের সাবেক ভিপি সিরাজুল ইসলাম রাজা মিয়া, আব্দুল জব্বার দুলাল, মহিউদ্দিন মধু, মজিবর রহমান বাদশা, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি শাহ আলম, মজিবুর রহমান চাঁন, খোন্দকার আনোয়ার হোসেন, আব্দুল জব্বার, মাহাবুবুল আলম লাটু, শহিদুল ইসলাম প্রমুখ। এছাড়াও জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ল’ কলেজ ক্যাম্পে যোগদান করেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে খোন্দকার আনোয়ার হোসেন-এর নেতৃত্বে একদল বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা বানারীপাড়ার বলহর ও খলিশা কোটায় ঘাঁটি স্থাপন করেন। শুদ্ধ ইতিহাস বিনির্মানের স্বার্থে এখানে একটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার। আর তা হল, থানা মুসলিম লীগ সভাপতি ও পরবর্তীতে বানারীপাড়া শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান গনি মোক্তার-এর বাড়ি খলিশা কোটায় ছিল। কিন্তু তিনি কখনোই মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো রকম অসুবিধার সম্মুখীন করেননি। উপরন্তু বলহার ক্যাম্পে কয়েকবার খাদ্য সহায়তা করেছিলেন।
১৮ এপ্রিল বরিশালের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনী বিমান হামলা চালায়। সেদিনই এয়ারপোর্ট ক্যাম্পের অধিকাংশ অস্ত্রশস্ত্র সহ অবশিষ্ট সকল বামপন্থীরা ল’ কলেজ ক্যাম্পে চলে আসেন। সমসাময়িক সময়ে শহরের কাউনিয়া ফাস্ট লেনে সিরাজ সিকদার-এর নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের একটি যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন খোরশেদ আলম খসরু।
২৫ এপ্রিল বিকেলে কাগাশুরা-পুরানপাড়ায় হেলিকপ্টার থেকে পাকিস্তানি প্যারাটুপার অবতরণ করে এবং একইদিনে সকালে পাকিস্তান বাহিনী জুনাহার-তালতলী এলাকায় গানবোট সহ হামলা চালায়। ফলে শহরের বিভিন্ন এলাকায় স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে রাস্তাঘাটে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে আত্মগোপনে চলে যায়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের একটি জিপগাড়িতে ইকবাল হোসেন ফোরকান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মোস্তফা শাহাবুদ্দিন রেজা ও গাড়িচালক টেনু সর্দার ফকির বাড়ী, কাটপট্টি সহ শহরের বিভিন্ন রাস্তা থেকে সেসব পরিত্যক্ত অস্ত্র সংগ্রহ করেন। এছাড়াও কাটপট্টির খগেন সাহা’র দোকানের পিছনের অংশ থেকে তৎকালীন এমপিএ আমির হোসেন আমু ও ইউসুফ হোসেন কালু তাদের দুটি রিভলভার ও একটি ব্যারেটা গান দিয়েছিলেন। ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত বামপন্থীরা এভাবে প্রায় শতাধিক অস্ত্র সংগ্রহ করেন। বামপন্থীদের সংগ্রহকৃত অস্ত্রের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। তবে মে মাসের মাঝামাঝি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রভাণ্ডারে দুইটি ভারতীয় স্টেনগান যুক্ত করেন।
আব্দুল ওহাব খান-এর সহায়তায় লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি থেকে সংগ্রহকৃত তিন নৌকা অস্ত্রগোলাবারুদ সহ ইকবাল হোসেন ফোরকান ২৬ এপ্রিল রাতে বাহেরচরে রাশেদ খান মেনন-এর পৈত্রিক ডাকবাংলোতে পৌঁছান। সেখানে মাটির নিচে অল্প কিছু অস্ত্র লুকিয়ে রেখে নৌকা গুলো ঝালকাঠির উত্তমপুর, উজিরপুরের করফাকর ও বানারীপাড়ার বলহরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মান্নান মৃধা’র তথ্যের ভিত্তিতে মে মাসের প্রথমদিকে ইকবাল হোসেন ফোরকান-এর নেতৃত্বে বাম রাজনৈতিক কর্মী সৈয়দ সুলতান, বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট সৈয়দ কবির ও কৃষ্ণ কান্তসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বানারীপাড়া থানার ওসি নজরুল দারোগার গোপন আস্তানায় হামলা চালিয়ে কয়েকটি অস্ত্র সংগ্রহ করে।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে উজিরপুরের হাত্তারপাড়া পুলিশ ক্যাম্পে ইকবাল হোসেন ফোরকান-এর নেতৃত্বে দশবারো জন মুক্তিযোদ্ধা হামলা চালালে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হয়। সারারাত যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প ইনচার্জ দারোগা আব্দুল বারী সহ ক্যাম্পের সকল পুলিশ পালিয়ে যায়। এই ক্যাম্প থেকেও বামপন্থীরা অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। সেই হামলায় করফাকরের ফজলু মাস্টার তথ্যগত সহায়তা করা ছাড়াও সশরীরে অংশগ্রহণ করেন। যদিও চারু মজুমদারের বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বোমার আঘাতে তিনি দুই পা হারিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও সেদিন তিনি বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন।
রহমতপুর নারিকেল বাগান এলাকায় একটি শক্তিশালী রাজাকার ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানি সেনারা নিয়মিত এই ক্যাম্পে এসে বিনোদনে লিপ্ত থাকতো। শফিউল্লাহ বিহারীর ছেলে রাজাকার খোকন সেই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল। ২রা জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে আটটায় ইকবাল হোসেন ফোরকান ও আবদুল ওহাব খান-এর যৌথ নেতৃত্বে প্রায় ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নারিকেল বাগান রাজাকার ক্যাম্পে সাঁড়াশি আক্রমণ করে। কয়েক ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধ শেষে মফেজ ঢালী, গেরিলা লতিফ, সৈয়দ সুলতান জামান ও ইকবাল হোসেন ফোরকান সহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হন। অন্যদিকে রাজাকার খোকন সহ তিনজন রাজাকার ও একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অবশ্য এই যুদ্ধের কয়েকদিন পরে শহরের হাসপাতাল রোডস্থ ইকবাল হোসেন ফোরকান-এর পৈতৃক বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে বাড়ির দরজা জানালা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীরা।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শাহ আলম ও মহিউদ্দিন মধু কর্ণকাঠীতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্থানীয় ভাবে গ্রহনযোগ্যতা থাকায় বিপ্লবী ঘড়নার রাজনৈতিক কর্মী ও মাটিভাংগা কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুস সাত্তারকে কমান্ডার নিযুক্ত করে ৩০/৩৫ জনের একটি দল গঠন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দলে সেনা সদস্য আব্দুল মান্নান হাওলাদার ফিল্ড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও নিজ নিজ বাহিনী ত্যাগ করে বেশ কয়েকজন ইপিআর ও আনসার সদস্য এই দলে যোগদান করেন। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে নবম সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মাহফুজ আলম বেগ-এর অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধা পরিমল চন্দ্র দাস-এর মাধ্যমে বেশ কিছু থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। বরিশাল মুক্ত থাকাকালীন সময়ে মেজর জলিল-এর ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ এই বাহিনীতে যোগ দেয়। তাছাড়া স্থানীয় ভাবে কিছু বন্দুক সংগ্রহ করা হয়।
২৫ মে দিবাগত রাতে আব্দুল মান্নান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম-এর যৌথ নেতৃত্বে মফিজুর রহমান মফিজ সহ এই বাহিনীর ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নলছিটি থানা আক্রমণ করে এবং সকাল পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। সেই যুদ্ধে নলছিটি’র বাড়ৈয়ারা গ্রামের মোঃ ইউনুস হাওলাদার শহীদ হন এবং আহত অবস্থায় কর্ণকাঠীর আবুয়াল হোসেন হাওলাদার ধরা পড়েন। পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনারা নির্মম নির্যাতন করে কোনো তথ্য আদায় না করতে পেরে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও শহরের হাসপাতাল রোডস্থ রেজায় রহিম ফেরদৌস সেই যুদ্ধে আহত হন।
নারিকেল বাগান যুদ্ধে আহত ইকবাল হোসেন ফোরকান’কে দেখতে ও অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে জুলাই মাসের প্রথমার্ধে সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্ণকাঠী থেকে বলহরে যান। সেখান থেকে বাহেরচরে লুকানো অস্ত্র সংগ্রহ করতে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ ও রাজা সহ সৈয়দ নজরুল ইসলাম’কে মুসলিম লীগ কর্মী রব সিকদার কৌশলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। একটি রিভলবার সহ গ্রেফতারের পরপরই তাদের বরিশাল শহরের পাকিস্তানি সেনাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওয়াপদা কলোনির পাকিস্তানি ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতনের পর মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ’কে হত্যা করা হয় এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও রাজা’কে যশোর ক্যান্টমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তি লাভ করে শহরের আলেকান্দার পৈতৃক বাড়িতে ফিরে এলে ২১ অক্টোবর রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার বাগেরহাটের আব্বাস তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং ওয়াপদা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সারা দেহ রক্তাক্ত করে হাত পা বেঁধে কীর্তনখোলা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। পরদিন ভোরবেলা চরআইছা খেয়াঘাট থেকে নৌকার মাঝিরা তাকে উদ্ধার করলে তিনি কেবল নিজের পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। কেননা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে উদ্ধারের অল্পক্ষণ পরেই তিনি মৃত্যু বরন করেন।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন নেতা সিরাজ সিকদার ঝালকাঠি আসেন। এখানে সিরাজ সিকদার-এর অনুগত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জাহাঙ্গীর কবীর, শশাঙ্ক পাল, মুজিবুল হক মেহেদী, শ্যামল রায়, জ্ঞানধীর কর্মকার, আ. সালাম প্রমুখ। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করতেন। ঝালকাঠি থানার দারোগা মুহাম্মদ সফিক-এর সহায়তায় সিরাজ সিকদার ও তার কর্মীরা থানার অধিকাংশ অস্ত্রগোলাবারুদ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এরপরই পাকিস্তানি দালাল আদম আলী ও রুস্তম আলীকে ঝালকাঠি লঞ্চঘাটে প্রকাশ্যে গুলি করে খতম করে এই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। ঝালকাঠির সরকারি গুদাম ভেঙে কয়েকশত মন চাল নিয়ে সিরাজ সিকদারের বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা শহরের অদূরে পেয়ারা বাগানে ঘাঁটি স্থাপন করে। বরিশালের ৪টি থানা ঝালকাঠি, বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি ও কাউখালীর ৬২ গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ পেয়ারা বাগান জুড়েই এই বাহিনীর অনেকগুলো ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এদের প্রধান ক্যাম্প ছিল ভীমরুলীতে। বিভিন্ন এলাকায় এই বাহিনীর প্রথম সাড়ির সামরিক কমান্ডার ছিলেন ভবরঞ্জন, মনসুর, রণজিৎ, জাহাঙ্গীর কবীর, আনিস, শ্যামল রায়, মানিক, নিলু ও শাহজাহান। রাজনৈতিক পরিচালক ছিলেন নুরুল ইসলাম ওরফে পন্ডিত, সেলিম ওরফে হিরু, আসাদ, ফুকু চৌধুরী, খোরশেদ আলম খসরু, রেজাউল, ফিরোজ কবির, মান্নান, সেলিম শাহনেওয়াজ, মোস্তফা কামাল মন্টু প্রমুখ। মে মাসের শুরু থেকে এই অঞ্চলে সিরাজ সিকদার বাহিনী বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করে বহু পাকিস্তানি সেনা, স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকার খতম করলেও পাকিস্তানি সেনা ও শর্ষিনা পীরের অনুসারী রাজাকার বাহিনীর ধারাবাহিক সাড়াশি আক্রমণের মুখে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে পর্যায়ক্রমে পেয়ারা বাগান এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সিরাজ সিকদার বাহিনীর পাশাপাশি পেয়ারা বাগান এলাকায় সাব সেক্টর কমান্ডার মাহফুজ আলম বেগ-এর অধীনে মুজিবনগর সরকারের প্রতি অনুগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিলো। তাদের সাথে কোনো রকমের সংঘাত না হলেও পরবর্তীতে সিরাজ সিকদার বাহিনী জেলার অন্যান্য স্থানে সাব সেক্টর কমান্ডার শাজাহান ওমর ও তার অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা মাসুমের নেতৃত্বে সিরাজ সিকদারের অনুগত মুক্তিযোদ্ধারা বাকেরগঞ্জ থানা আক্রমণ করেছিলেন। সেই ঘটনার কয়েকদিন পর পাদ্রীশিবপুরে বাকেরগঞ্জ থানার অন্যতম বেইজ কমান্ডার আবু জাফর-এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা মাসুম ও ভাস্কর’কে হত্যা করা হয়। এছাড়াও মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুরে সিরাজ সিকদারের অনুগত মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করেছিলেন স্বয়ং সাব সেক্টর কমান্ডার শাজাহান ওমর। যদিও সাব সেক্টর কমান্ডারদের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের তারা কখনোই আক্রমণ করেনি। তবে নিজেদের দলের বাইরের বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের দখল নিতে কখনো কখনো সংঘাতে জড়িয়ে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জুন মাসে গুঠিয়া সংলগ্ন হক সাহেবের হাট এলাকায় এই ধরনের একটি ঘটনায় নুরুল ইসলাম পন্ডিত সহ সিরাজ সিকদারের অনুগত এগারো জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের প্রথমার্ধে পেয়ারা বাগানে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান অন্যান্য সকল মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল। এতকিছুর পরও সিরাজ সিকদারের অনুগত মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার প্রশ্নে শেষপর্যন্ত আপোষহীন ভূমিকা পালন করেছিলেন।
হাইকমান্ডের নির্দেশনা বা অন্যকোনো কারণে সিরাজ সিকদার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সাব সেক্টর কমান্ডার শাজাহান ওমর বৈরী মনোভাব পোষণ করলেও অন্যান্য বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। অধ্যাপক আবদুস সাত্তার’কে তিনি কোতোয়ালি থানার অন্যতম বেইজ কমান্ডার নিয়োগ দেন। অধ্যাপক সাত্তার-এর নেতৃত্বে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা সাব সেক্টর কমান্ডার শাজাহান ওমর-এর অধীনে বিভিন্ন অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন। এছাড়াও শাজাহান ওমর-এর ছত্রচ্ছায়ায় বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল শহরের বিভিন্ন এলাকায় আতর্কিত গ্রেনেড হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে যুক্ত ব্যক্তি এবং স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার করেছিলেন। এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার, সুলতান আহমেদ খান ও আলমগীর হোসেন প্রমুখ সাহসী ভূমিকা রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন বরিশাল জেলার অন্তর্গত পিরোজপুরে ভাসানী ন্যাপ ও কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি’র রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি তুলনামূলক ভাবে বেশি ছিল। ২৫ মার্চের অব্যবহিত পরেই বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক (ফজলু)-এর নেতৃত্বে ৩০/৩৫ জনের একটি বাহিনী পিরোজপুর ট্রেজারী থেকে প্রচুরসংখ্যক অস্ত্রগোলাবারুদ ও টাকা পয়সা সংগ্রহ করে। এই অভিযানে ওবায়দুল কবির বাদল, নুরদিদা খালিদ রবি, জামালুল হক মনু, শামসুদ্দোহা মিলন, শহীদুল হক চাঁন, সমীর কুমার প্রমুখ অংশ নেন। পরবর্তীতে এসব অস্ত্রের একটি অংশ বিষ্ণুপুরে সমন্বয় কমিটি নেতা শহীদুল আলম নীরু ও রফিকুল ইসলাম খোকন-এর কাছে পাঠানো হয়েছিল। এরপর ৫ই মে ফজলুল হক, পুর্নেন্দু বাচ্চু, প্রবীর বাচ্চু, জাহাঙ্গীর, দেবু’কে স্থানীয় দালালদের সহায়তায় গ্রেফতার করে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর কিছুদিন পর বিধান চন্দ্র মন্টু শহীদ হয়েছিলেন। তারপর কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটির পিরোজপুর শাখার নেতা ওবায়দুল কবির বাদল-এর নেতৃত্বে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের পুরোটা সময় দেশের মাটিতে অবস্থান করে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন।
বরিশালের রণাঙ্গনে একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত নুরুল ইসলাম মনজুর-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতারা অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করলেও এরপর থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত তারা ভারতে অবস্থান করেন। কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া ২৫ এপ্রিল পরবর্তী সময় থেকে বরিশালের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন, ৮ই ডিসেম্বরের পর থেকে তারা জনসম্মুখে আসতে শুরু করেন। সেসময়ে বৃহত্তর বরিশাল জেলার মাঠপর্যায়ে বামপন্থী নেতাকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছেন। অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল অঞ্চলে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত বাম ও প্রগতিশীল সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থক সহ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অরাজনৈতিক ব্যক্তি বিশেষ করে সেনা, ইপিআর ও আনসার সদস্যরা জীবনবাজি রেখে লড়াই চালিয়ে যান। তবে একথা সত্যি, অরাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আজ বরিশালের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা ইতিহাস থেকে একেবারে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেও কোনো বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধার কপালে জোটেনি রাষ্ট্রীয় খেতাব। বরিশালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখকদের মধ্যেও রণাঙ্গনে বামপন্থীদের সাহসী ভূমিকা অস্বীকার করার সহজাত প্রবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়। তাই বরিশালের রণাঙ্গন সহ মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস নতুন করে লেখার একান্তভাবে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
পুনশ্চঃ এই প্রবন্ধে বৃহত্তর বরিশাল জেলায় বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের কালজয়ী ভূমিকার খুবই সামান্য অংশ তুলে ধরা হয়েছে। বরিশালের রণাঙ্গনের অসংখ্য বামপন্থীদের নাম এখানে যেমন আসেনি, তেমনি তাদের বহু লড়াইয়ের ইতিহাস তুলে ধরা যায়নি।
(দায় লেখকের)

© 2023 বরিশাল বাণী কতৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by Eclipse Web Host