সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা নদি মাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল আমাদের বিভাগীয় শহর বরিশালকে এক সময় দ্যা ভেনিস অব বেঙ্গল বলা হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বরিশালের মা মাটি ও মানুষের বহুবিদ অবদান রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে অনেক কবি, সাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ এর বর্ননা করেছেন।
আমিও আজ আমার সামান্য জ্ঞানে কিছুটা আলোচনা করছি পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে।
১৯৭১ইং সালের ২৪শে এপ্রিল সংবাদ এলো পাক হানাদার বাহিনী ফরিদপুর আক্রমন করেছে আর যেকোন মুহুর্তে
বরিশাল আক্রমন হতে পারে। তাই বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারা সতর্ক অবস্থান নেন প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য।
আর প্রতিরোধে বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের ২টি যুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয়েছিল।
১। জুনাহার যুদ্ধ ও
২। চরবাড়িয়া যুদ্ধ
জুনাহার যুদ্ধঃ ২৫ এপ্রিল সকাল ১১ টা ৪৫ মিনিটে পাকিস্তান নৌবাহিনী জুনাহার আক্রমণ করে। জুনাহারের
পশ্চিমে সায়েস্তাবাদ এবং পূর্ব দিকে চরমোনাই ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন ও তালতলী।
সায়েস্তাবাদ নদী হতে জুনাহার হয়ে কীর্তনখোলা নদীতে যেতে হয়। পাকবাহিনী জলে-স্থলে ও আকাশ পথে বরিশালের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর ধারণা ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। তাই তারা শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে বরিশালে আক্রমণ চালায়। জুনাহারের পশ্চিম পাড়ে হবিনগরে, পূর্ব পাড়ে রাজাপুরে এবং দক্ষিণ পাড়ে ফোটকার চরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয়। লে. ইমাম আলী মেহেদী, লেঃ নাসির, ফ্লাইট সার্জেন্ট মুহাম্মদ ফজলুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করেন। সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন নূরুল ইসলাম মঞ্জুর। প্রথমে গানবোট হতে সায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের হবিনগর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। গানবোট ঘায়েল করার জন্য তাদের কোন অস্ত্র ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে গোলার আঘাতে স্টীমার ইরানী ও মাজভী ডুবে যায়। ভারী অস্ত্রের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বাংকার ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেকে নিহত ও আহত হয়। জুনাহারে ইছাকাটির আবদুল মোতালেব আকন্দ, গৌরনদী থানার স্যারালের সিপাহী সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ সম্মখ যুদ্ধে শহীদ হন| মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রের সাথে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়। ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর জুনাহারে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির পতন হয়।
চরবাড়িয়ার যুদ্ধঃ বরিশাল পৌরসভা সংলগ্ন লামচরী, তালতলী, চরবাড়িয়া, মহাবাজ, উলানঘুনী, মতাসার, কাগাশুরা,বাটনা, আমীরগঞ্জ, প্রভৃতি গ্রাম নিয়ে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন। পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধে মেজর জলিলের রণকৌশল অনুযায়ী বরিশাল শহরতলিতে অবস্থিত চরবাড়িয়া ইউনিয়নের মহাবাজ বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর দুইশত পঞ্চাশ জন সদস্য নিয়ে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। ক্যাম্প পরিচালনায় ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, সুবেদার পঞ্চম আলী। সায়েস্তাবাদ হাইস্কুলে ট্রেনিংয়োর দায়িত্বে ছিলেন
আনসার কমান্ডার আবদুল ওয়াজেদ হাওলাদার। ২৫শে এপ্রিল দুপুরে চরবারিয়া আক্রমণ করে পাক বাহিনী। এরপর পাকবাহিনী নৌ, বিমান ও স্থল বাহিনীর সমন্বয়ে বরিশাল আক্রমণ করতে থাকে। তাঁদের আক্রমণে সমগ্র এলাকায় ভয়ঙ্কর ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাড়ি বাড়ি ঢুকে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে হত্যা করে। যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করতে থাকে। এতে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন জনশূন্য হয়ে পরে এবং বরিশাল শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেয়। ২৫-২৬ এপ্রিল রাতে মৃতদেহ ব্যতীত কেউ ছিল না চরবাড়িয়া ইউনিয়নে।
এরপর মেজর জলিল কিছু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারত থেকে ২টি লঞ্চ বোঝাই করে অস্র নিয়ে আসার পথে পাক
বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন। এক পর্যায়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সুযোগ বুঝে তারা লঞ্চ থেকে তীরে নেমে পায়ে হেঁটে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। অস্র সংগ্রহের উদ্যেশ্য বরিশাল ও পটুয়াখালী শত্রু মুক্ত করে দখল নেয়া।
নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও মেজর জলিল পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহ করে সীমান্তে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন।
এপ্রিলে মেজর জলিলকে নবম সেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, মাদারীপুর ও
গোপালগঞ্জের একাংশ নবম সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বরিশালে সংগঠিত বিভিন্ন যুদ্ধ সমূহঃ
হেমায়েত বাহিনীর যুদ্ধ: ১৯৭১ সালে হেমায়েত উদ্দিন গোপালগঞ্জ ও বরিশালের গৌরনদী নিয়ে গঠিত সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। ৯ জন সৈন্য নিয়ে হেমায়েত বাহিনীর শুরু। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী তার পিতা ও স্ত্রী হাজেরা বেগমকে গুলি করে হত্যা করে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করেন।
বড়াকোটা-হারতা যুদ্ধ: শাহজাহান ওমর দায়িত্ব গ্রহণের পরই পাক বাহিনী ৫ সেপ্টেম্বর উজিরপুরে হারতা গ্রাম ক্রমণ করে এবং ১৯ জনকে হত্যা করে।
এ ছাড়াও দোয়ারিকা ও জয়শ্রীর যুদ্ধ, গৌরনদীর যুদ্ধ, বাকেরগঞ্জ যুদ্ধ এরকম অনেক যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল।
বরিশাল শত্রুসেনা মুক্তি (৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১ইং) নভেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধা মুজিবনগর থেকে বরিশাল আগমন করে। মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল, পটুয়াখালী রিভিন্ন রণাঙ্গণে সুশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত পাক সেনাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে তাদের শক্তি ও বীরত্বের পরিচয় দেয়। ৪ঠা অক্টোবর প্রায় দুইশত মুজিববাহিনী যশোর হয়ে বরিশাল ও ফরিদপুরে আসছিল। কিন্তু পাক বাহিনীর বিমান হামলায় অনেকে নিহত হয়। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ একদল মুজিব বাহিনী নিয়ে গোপালগঞ্জ হয়ে গৌরনদী আসেন।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিলে মিত্রবাহিনী গঠন করে একযোগে পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। পাক সেনারা ১৬ নভেম্বর হতে বরিশাল, পটুয়াখালীর ক্যান্টনমেন্টে সীমাবদ্ধ থাকে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রায় সকল থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর বরিশাল ও রহমতপুর বিমান ঘাঁটিতে মিত্র বাহিনী বোমা বর্ষণ করে। ৮ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় বরিশালে পাক সেনারা কার্ফু দেয়। যশোর ও খুলনা থেকে পাক সেনারা পালিয়ে আসে এবং তারা কয়েকটি লঞ্চে ঢাকা অভিমুখে যাবে। বরিশাল ওয়াপদা অফিসের পাকসেনা বেলা ১১টার মধ্যে লঞ্চে আরোহণ করে। তারা ১২টার মধ্যে লঞ্চ ও স্টিমারযোগে বরিশাল ত্যাগ করে।এদিকে সঙ্গে সঙ্গে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা চলতে থাকে। সংবাদ পেয়ে আগরপুর হতে নূর হোসেন কমান্ডার ও হাজার হাজার গ্রামবাসী ছুটে আসে। নূর হোসেন অনেক পাক সেনা হত্যা করে।১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল স্বাধীন হয়। ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস। বেলা ১১টার পরই জনগণ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির দালালেরা দ্রুত পালাতে থাকে। সকল বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। ৮ ডিসেম্বর বিকালে সুলতান মাস্টার তার বাহিনী নিয়ে শহর উঠে পড়ে। ১০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর শহরে আসে। তারপর সকল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাদের দল নিয়ে শহরে আসতে থাকে। চারদিকে বিজয় উল্লাস। আবার অনেকে প্রিয়জনদের হারানো ব্যথায় অশ্রু ফেলছে।মুক্তিযোদ্ধারা দালালির অভিযোগে শর্ষিনার পীর মওলানা আবু জাফর মুহম্মদ সালেহ, মুসলিম লীগনেতা সৈয়দ মুহম্মদ আফজাল, আবদুর রব, শমসের আলী, সুলতান সর্দার, ইলিয়াস মাস্টারকে গ্রেফতার করে। অনেক দালালকে মৃত্যুদন্ড- দেয়া হয়।
এমতাবস্থায় জেলার শাসন নিয়ে সমস্যা হয়। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আবদুর রহমান বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তার দপ্তর ছিল পেশকার বাড়িতে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর নিজেকে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে জেলার প্রধান বলে দাবি করলেন। ১৭ ডিসেম্বর নুরুল
ইসলাম মঞ্জুর প্রায় পাঁচশত মুক্তিযোদ্ধাসহ বরিশাল শহরে পৌঁছেন এবং তিনি সাময়িকভাবে জেলার প্রশাসন
পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।১৮ ডিসেম্বর মেজর এম এ জলিল বরিশাল পৌঁছলে তাকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা দেয়া হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে নুরুল ইসলাম মঞ্জু ও মেজর এমএ জলিল তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে সফল অংশগ্রহণের জন্য সুনাম ও খ্যাতি লাভ করেন। ২১ ডিসেম্বর হেমায়েত উদ্দীন খেলার মাঠে বিজয় উপলক্ষে বিরাট জনসভা হয়। সেখানে নুরুল ইসলাম মঞ্জু ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ বক্তৃতা দেন।
আমরা বরিশালবাসী অনন্তকাল তাঁদের এই অবদানের কথা মনে রাখবো এবং পরবর্তীদের সঠিক ইতিহাস বর্ননা করে সাহায্য করবো।
(তথ্য সংগৃহীত)