বরিশাল সদর হাসপাতালঃ সেবা পেতে রোগীদের পদে পদে ভোগান্তি

প্রকাশের তারিখ: জুলাই ১, ২০২০ | ৯:৪০ অপরাহ্ণ

সাঈদ পান্থ ॥ করোনা ভাইরাসের এই ক্লান্তিকালেও বরিশাল আধুনিক জেনারেল হাসপাতাল (সদর হাসপাতাল) থেকে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না রোগীরা। চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি ও আন্তরিকতার অভাবে এই হাসপাতালের করুণ অবস্থা। যার কারণে এই সংকট মুহূর্তে জেলার হাজার হাজার রোগী ও তাদের স্বজনদের পড়তে হচ্ছে বিপাকে। ঘুরছেন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। করোনা আক্রান্ত হবার ভয়ে চিকিৎসকরা হাসপাতালে আসছেন না বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। এ অবস্থায় প্রশাসনের তদারকির দাবী জানিয়েছেন ভুক্তোভগি রোগী ও রোগীর স্বজনরা।
গত ১৯ জুন কভিড-১৯ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের ডার্মাটোলজীর সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা এমদাদুল্লাহ খান মারা যান। তার মৃত্যুর পর স্তব্ধতা নেমে আসে এই হাসপাতালে। পূর্বে কিছু কিছু চিকিৎসক বিভিন্ন সময় হাসপাতালে আসলেও এই মৃত্যুর পর চিকিৎসকরাই আসতে ভয় পাচ্ছেন।

এর কারণে চিকিৎসকরা অনুপস্থিত বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টতারা।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কক্ষের দরজা বন্ধ। এমনকি ওয়ার্ড গুলোতেও চিকিৎসকদের খুব একটা দেখা নেই। ওয়ার্ড বয়রা জানান, কোন কোন চিকিৎসক এসে কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতাল থেকে চলে এসেছেন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে হাসপাতালে আসতে পারেন নি। তবে একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে ডিউটি করার জন্য যে ধরনের ব্যক্তিগত করোনা প্রতিরোধক সামগ্রী (পিপিই) দেয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত ও কার্যকর নয়। মাত্র কদিন আগে সেখানকার চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ডা. এমদাদুল্লাহ খান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। যে কারণে তাদের পরিবার ভীত হয়ে তাদেরকে কর্মস্থলে আসায় বাঁধা প্রদান করছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তাদের সেখানে বর্তমানে জরুরী চিকিৎসা সহায়তা নিতে প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন রোগী ভিড় করেন। জরুরী বিভাগে দায়িত্বরত নার্সিং কর্মকর্তা মোঃ ছগির হোসেন জানিয়েছেন, তাদের সেখানে ১৭ জন রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছেন। বহিঃবিভাগে এই সংখ্যা দুই থেকে তিনগুণ বেশি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কারণে এত রোগী পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিতে পারছেন না। এছাড়া সেখানে করোনা পরীক্ষার জন্য প্রতিদিন ৬০-৭০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নিজেদের পরীক্ষাগার না থাকায় এসব নমুনা পরীক্ষার জন্য নগরীর শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হয় তাদের। পরীক্ষাগার না থাকলেও করোনা চিকিৎসার জন্য আলাদা ইউনিট আছে তাদের। সেখানে বর্তমানে ১১ জন রোগী চিকিৎসারত অবস্থায় আছে।

জানা গেছে, এই হাসপাতালটিতে করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করেন দুজন টেকনোলজিস্ট। তাদের মধ্যে একজন নওয়াব হোসেন। তিনি প্রতিদিন বাড়ি থেকেই এসে দায়িত্ব পালন করেন। করোনার নমুনা সংগ্রহ শেষে হাসপাতালে নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে জীবাণুমুক্ত করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সেখানে নেই। এমনকি তার কাজ শেষ করে হাসপাতাল থেকে গণপরিবহনে বাড়ি ফেরেন। এতে করে গণপরিবহনে থাকা অন্য মানুষও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে।
অন্যদিকে সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কথা হয় বরিশাল সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়ন থেকে সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন সোনিয়া আক্তারের সাথে। তিনি জানান, তাঁর ১৪ বছরের মেয়ে কদিন আগে গাছ থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গেলে তারা এই হাসপাতালে যোগাযোগ করার জন্য বলে দেন। গত দুদিন মেয়েকে নিয়ে এখানে এলেও চিকিৎসক না পাওয়ায় সেবা বঞ্চিত রয়েছেন তারা।
হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসাইন জানান, স্থানীয় উদ্যোগে ১৯১২ সালে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে বরিশালে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপণ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ হাসপাতালটিই ছিল বরিশাল অঞ্চলের জনগণের চিকিৎসার প্রধান ভরসা। বর্তমানে ২০০ শয্যার আধুনিক সদর হাসপাতাল নাম দেওয়া হলেও হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসার কিছুই নেই।
এই হাসপাতালে কত চিকিৎসক কর্মরত ও দৈনিক কতজন চিকিৎসা সেবা প্রদান করে এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক (আবাসিক মেডিকেল অফিসার) ডাঃ দেলোয়ার হোসেন জানান, এসব তথ্য তাঁর আপাতত জানা নেই। তবে প্রায় সবাই অফিস করছেন বলে তিনি জানান।
বরিশাল সদর হাসপাতাল উন্নয়ন ও সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি তারিক বিন ইসলাম জানান, বরিশাল জেলার লক্ষাধিক মানুষের ভরসার জায়গা এই হাসপাতাল। কিন্তু চলমান সংকটময় মুহূর্তে এখানকার চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার নানা অভিযোগ তাঁর কাছেও এসেছে। হাসপাতালটির চিকিৎসকদের প্রতি আহবান থাকবে তারা যেন বর্তমান পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল আচরণ করেন।
বরিশাল জনসার্থ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ও বরিশাল জেলা পরিষদের সদস্য মানুওয়ারুল ইসলাম অলি জানান, অকার্যকর পিপিই এবং জনবল সংকটের দরুণ বর্তমানে জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতালটির পরিষেবাগুলো থমকে যাবার পথে। এ বিষয়ে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের দ্বায়িত্বশীল আচারণের দাবী জানান। তিনি বলেন, প্রশাসন যতি তাদের তদারকি বাড়িয়ে দেয় তবে এই হাসপাতালটি হাজার হাজার মানুষের সেবা দিতে পারে।

© 2023 বরিশাল বাণী কতৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by Eclipse Web Host