১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আমাকে চিৎ করে শুইয়ে পুলিশ আমার হাত-পা পাড়িয়ে ধরে। এরপর আমার পেটের উপর বসে

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

অনলাইন ডেস্ক:
বাদীর পরে এবার পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেছেন বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের বুখাইনগর রাজধর গ্রামে খুন হওয়া দলিল লেখক রেজাউল করিম রিয়াজ হত্যা মামলার আসামী ও নিহতের স্ত্রী আমিনা আক্তার লিজা। শনিবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টার দিকে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন তিনি।

এসময় লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে তাকে রাতভর থানায় আটকে রেখে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বর্বর পুলিশি নির্যাতন এবং ঘুষ বানিজ্য ও স্বামী হত্যার দায় কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন তিনি। সেই সাথে তিনি বিচার দাবি করেন নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তা এসআই বশির আহমেদ (বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত) ও এসআই ফিরোজ আল মামুন এবং মামলার বাদী মনিরুল ইসলাম রিপনসহ জড়িত থানা পুলিশ অন্যান্য কর্মকর্তাদের।

লিখিত বক্তব্যে আমিনা আক্তার লিজা বলেন, গত বছর ১৮ এপ্রিল দিবাগত রাতে নিজ ঘরে খুন হন তার স্বামী দলিল লেখক রেজাউল করিম রিয়াজ। তার খুন হওয়ার সময় তিনি অন্য কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন। ধস্তাধস্তির শব্দ পেয়ে জেগে উঠে স্বামীকে খুন করার বিষয়টি নিশ্চিত হন। তখন ভয়ে দৌড়ে ঘরের বাইরে গিয়ে প্রতিবেশীদের ডেকে তোলার চেষ্টা করলেও তারা কেউ সাড়া দেয়নি। একজন সাড়া দিলেও তিনি খুন হয়েছে শুনে দরজা বন্ধ করে দেন।

তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরদিন সকালে পুলিশ আমাদের বাড়িতে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাকে, আমার মা, ভাই, বোন এবং দেবরকে কোতয়ালী থানায় নিয়ে যায়। এর কিছু সময় পরেই জানতে পারি কিছু টাকার বিনিময়ে আমার দেবর মনিরুল ইসলাম রুবেলকে পুলিশ থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য আমাকে অমানুষিক নির্যাতন, ভাই-বোনদের আটকের পাশাপাশি যৌননির্যাতন করার ইঙ্গিত দিয়েছিলো এসআই বশির। সেখানো স্বীকারোক্তি না দিলে আবারও রিমান্ডে এনে নির্যাতনের ভয় দেখানো হয়। আদালতে নেয়ার পর আমাকে একই ধরনের তিনজন কর্মকর্তার কাছে নিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলায় আমি বুঝতে পারিনি আসল বিচারক কে।

থানায় রাতভর আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিজা বলেন, ‘১৯ এপ্রিল আমাদের সবাইকে একটি কক্ষে রাখে। এরপর আমার মা, ভাই ও বোনকে আলাদা কক্ষে নিয়ে আটকে রাখে। আমাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতেছিলো। আমি ঘটনাগুলি বলতেছিলাম। তবে ঐদিন মনে হচ্ছিল আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের কোন উৎসবের দিন। কারণ তারা থানায় বিরিয়ানির প্যাকেট, কোমল পানিয়র কেচ, সাদা পানি এবং বেনসন সিগারেটের বক্স অনবরত থানায় নিয়ে আসছিলো।

তিনি বলেন, ‘আছরের আযানের পরে হাতে একটা ফাইল নিয়ে এসআই বশির আহমেদ আমার ওই কক্ষে প্রবেশ করে। এরপর আমাকে মুখমন্ডল লক্ষ করে লাথি মারে। এতে আমার অনেক রক্তক্ষরণ হয়। এরপর আমাকে থানার দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যায়। আমার দুই হাত টেবিলের উপর রেখে পেপার ওয়েট দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করতে থাকে এবং আমার পায়ের বুরো আঙ্গুল পা দিয়ে পারাইতেছিলো। এতে আমি অনেক চিৎকার করি। এরই ভিতর এসি রাসেল স্যার আসে, এসে বলে ‘এত চিৎকার করিস ক্যান’। আমি তাকে বলেছিলাম পুলিশ আমাকে মারে। কিন্তু পুলিশ বলতেছিলো আমাকে তারা মারে না। এর পর সে চলে যায়। আমার মাথার চুল ধরে নিচু করে রাখে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থায় নিয়ে আসে। এতে আমার চুল খুলে গেলে অন্য পুলিশেরা আমার চুল ধরে টানাটানি করতে থাকে এবং অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে। এরই মধ্যে সাদা পোশাকের একজন পুলিশ সে বলল্য ওকে আর কোন প্রশ্ন করিস না। সব কথা রিমন ভাইয়ের সাথে হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘দিনভর নির্যাতন করতে করতে রাত হয়ে যায়। পরে আমার চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে একটি অন্ধকার রুমে নিয়ে যায়। সেখানে আমার গাঁ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে চিৎ করে সুসিয়ে ৭-৮ জন পুলিশ আমার চার হাত পা পাড়িয়ে ধরে। এরপর সাদা পোশাকের পুলিশটা আমার পেটের উপর বসে যায়। আমার মুখে একটা গামছা বেধে মুখের উপর পানি ঢালতেছিলো। আর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিতেছিলো। এরকম একবার করার পর আমার নাকের কাছ থেকে ফাঁকা করে দিয়ে বলে তাদের কিছু লিখিত বক্তব্য আমি যদি আদালতে বলি তাহলে তারা আমাকে ছেড়ে দিবে। এরই মধ্যে এসি রাসেল স্যার এসে বলতেছিলো কি করিস তোরা এখনো স্বীকার করাইতে পারিসনি। এভাবে আরো একবার কর।

লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘তারা আমাকে বলতেছিলো তোর বোনতো কচি আছে। তোর মা বয়স্ক তাকে কি হয়েছে এবং তোর ভাইকে মেরে শের-ই-বাংলায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। যখন আমাকে অত্যাচার করে তখন আমি ১৫ দিনের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের এই অত্যাচার সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই তাদের কথা মেনে নিতে বাধ্য হই এবং তাদের শিখিয়ে দেয়া কিছু লিখিত বক্তব্য আদালতে বলতে বাধ্য হই।”

এদিকে সংবাদ সম্মেলনে লিজা শুধুমাত্র পুলিশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেননি। অভিযোগ করেছেন তার ভাসুর মনিরুল ইসলাম রিপনের বিরুদ্ধে। তার অভিযোগ, নিহত স্বামী রিয়াজের ভাই মনিরুল ইসলাম রিপন তাকে ও তার সন্তানকে সম্পত্তি বঞ্চিত করার জন্য এসআই বশির আহমেদের সঙ্গে যোগাসাজস করে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। এমনকি ডিবি পুলিশ যেখানে হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করে হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করেছে, সেখানে রিপন বিভিন্নভাবে মিথ্যা, ভিত্তিহিন এবং বানোয়াট তথ দিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করাচ্ছে।

এমনকি কারাগারে জন্ম নেয়ার আমার সন্তনকেও তারা অস্বীকার করছে। আমার স্বামীর দুই-তিন কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। এছাড়া একটি বাড়ি ভোগ দখল করছে রিপন। এসময় সম্পত্তি আত্মসাত করতেই সে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার এবং ষড়যন্ত্র করছে। এর আগে গত মার্চ মাসে সে আমার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা অভিযোগে মামলা করে। যা আদালত খারিজ করে দিয়েছে।

এসময় আমিনা আক্তার লিজা, বিএমপি কমিনার এবং গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ছবির হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি তাকে নির্যাতনকারী এবং ঘুষ আদায় করা দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ জড়িত থানার অন্যান্য কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমুলক বিচার এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে স্বামী হত্যার দায়মুক্ত করার দাবি জানান।

প্রসঙ্গত, ‘গতবছর ১৮ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে নিজ ঘরে খুন হয় দলিল লেখক রেজাউল করীম রিয়াজ (৪৫)। হত্যাকান্ডের পর পুলিশ হেফাজতে থাকাবস্থায় ২০ ফেব্রুয়ারী লিজার পরকিয়া প্রেমিক মাসুমকে সঙ্গে নিয়ে স্বামী হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার অধিকতর তদন্তকালে গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. ছগীর তিন চোর গ্রেফতার করলে তারাও রিয়াজকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়। তারা বলেছে, ঘরে চুরি করতে ঢুকলে রিয়াজ জেগে ওঠায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ফলে এ মামলটি বর্তমানে বরিশালে আলোচিত ঘটনায় পরিনত হয়েছে। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক বশির আহমেদকে অন্য একটি ঘটনায় ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ গত রোববার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফিরোজ আল মামুন এখনো দায়িত্বরত রয়ছেন।

সর্বশেষ