১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গরীবের উপকার করে নিজেই ফেঁসে যাচ্ছিলাম !

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

১৯৯৮ সাল। সবেমাত্র সাংবাদিকতা শুরু করেছি নিতান্তই শখের বসে। সেই শখ থেকে নেশা- আর নেশা থেকেই পর্যায়ক্রমে পেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়া। আমি তখন দৈনিক জনতা পত্রিকার বোরহানউদ্দিন উপজেলা (ভোলা) প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। সহকর্মি সাংবাদিক শিমুল চৌধুরী এবং দীন ইসলাম রুবেলের সাথে নিউজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতাম উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের অলিগলি ।
কোন সংবাদের সূত্র পেলে ছুটে যেতাম ঘটনাস্থলে। এভাবে কেটে যাচ্ছে সময়। একদিন খবর পেলাম কাঁচিয়া ইউনিয়নের গ্যাসফিল্ড এলাকায় রহিমা নামের এক তরুণী আত্নহত্যা করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই থানায় খবর আসে, পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়, লাশের পোস্টমর্টেম হয়, এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে মৃত্যুর সময় ওই তরুণী ছিল অন্ত:সত্ত্বা। ওই এলাকার রতন খার বাসায় (কাজের মেয়ে) ঝি-এর কাজ করতো সে। রহিমার দরিদ্র বাবা চট্রগ্রামে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। অভাবের তাড়নায় মেয়েকে ওই বাসায় কাজ করার জন্য রেখে যান। এই সুযোগে রতন খাঁর আত্নীয় এবং প্রতিবেশি রফিক পটোয়ারী বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে রহিমার সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে। একপর্যায়ে রহিমা অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়লে তার গর্ভের সন্তান নস্ট করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। রহিমা এতে রাজী না হওয়ায় জোরপূর্বক মূখে বিষ ঢেলে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশ পুকুর পাড়ের আম গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে আত্নহত্যার অপপ্রচার চালানো হয়।

খবর পেয়ে চট্রগ্রাম থেকে ছুটে আসেন রহিমার বাবা। একমাত্র কন্যার মৃত্যুসংবাদ শুনে সেদিন একজন দরিদ্র বাবার করুন আহাজারিতে শোকার্ত হয়ে উঠেছিল ওই এলাকার পরিবেশ। পোস্ট মর্টেমের পর লাশ দাফন করা হয়। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত ফলোআপ আসে, রহিমার চাচা বলু মিয়া বাদি হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। দরিদ্র ওই পরিবারকে আর্থিক ও আইনী সহায়তা প্রদান করেছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মিরা। সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন দৈনিক মাতৃভূমির তৎকালীন বোরহানউদ্দিন উপজেলা প্রতিনিধি দীন ইসলাম রুবেল। এদিকে নিউজের ফলোআপ রিপোর্ট প্রকাশ অব্যাহত রাখি আমি আর শিমুল চৌধুরী। মানবাধিকারের দায়িত্ব থেকে আমরা আমাদের নিজেদের পত্রিকার পাশাপাশি অন্যান্য সাংবাদিকদেরও তথ্য সরবরাহ করে সংবাদ প্রকাশে সহযোগিতা করতে থাকি। তখনকার এই ঘটনাটি বিশেষ করে রহিমার বাবার আহাজারির দৃশ্যটি আমাকে দারুনভাবে নাড়া দিয়েছিল। যার কারনে অন্যান্য সংবাদের পাশাপাশি নিয়মিত এ বিষয়টির ফলোআপ অব্যাহত রাখি।

এক পর্যায়ে আসামিরা তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদককে বিশাল অংকের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার প্রচেষ্টা চালান। যার কারনে পুলিশ আসামীদের ধরার ব্যাপার উদাসীন হয়ে যায়। এমনি মুহূর্তে আমি তখনকার জনপ্রিয় দৈনিক ইনকিলাবের নারী পাতায় ‘নীরবে কাঁদে রহিমা হত্যার বিচার’ শিরোনামে একটি মানবিক ফিচার লিখি। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর ভোলার মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বন্ধুজন’ সহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। এসময় মামলার অন্যতম আসামী বাহাদুরের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী বগি (ধারালো অস্ত্র) নিয়ে ভোলা থেকে আসা মানবাধিকার কর্মি ও সাংবাদিকদের ধাওয়া করে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন। বিষয়টি পরের দিন প্রায় সবকটি পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ হলে প্রশাসনের টনক নড়ে। ভোলা জেলার পুলিশের কর্মকর্তারা সরাসরি মামলা তদারকির দায়িত্ব নেন। একে একে গ্রেফতার হতে থাকে আসামীরা। দূর্ধর্ষ বগি বাহাদুরও গ্রেফতার হয়। দীর্ঘদিন পর জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসে বগি বাহাদুরসহ অন্য আসামীরা।।

এবার আসামীরা কৌশল পাল্টিয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ফেলে নিহত রহিমার বাবাকে। লোকটি (রহিমার বাবা) একবারও ভাবলেন না যে, তার মেয়ের হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি ও সঠিক বিচারের জন্য পকেটের টাকা খরচ করে- জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মিরা। তাছাড়া নিজ মেয়ের হত্যাকারীদের সাথে কি কখনো আপোষ করা যায়? কে শোনে কার কথা। সে যাই হোক এক পর্যায়ে টাকার লোভে মামলা তুলে নেন রহিমার বাবা। আসামীরা একে এক বেরিয়ে আসে জেল থেকে।

এ ঘটনার পরের দৃশ্যটি অন্যরকম। এবার আসামীরা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তারা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মিদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের যুক্তি -‘আমাদের বিরুদ্ধে যেহেতু হত্যার ঘটনা প্রমাণিত হয়নি অতএব পূর্বে আমাদের বিরুদ্ধে যত নিউজ করা হয়েছে সব মিথ্যা ! আমাদের বিরুদ্ধে মামলার ড্রাফট নিয়ে আসা হয় থানায়, বোরহান উদ্দিন থানা পুলিশ যেহেতু পূর্ব থেকেই ঘটনার সবকিছু অবহিত ছিলেন, এবং আমরা সব সাংবাদিকরা এবিষয়ে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। সেহেতু থানা পুলিশ বিষয়টি আমলে নেয়নি। ভোলা কোর্টে মামলা করতে গেলেও ভোলার সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কতর্মিদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সফল হতে পারেনি ওই সন্ত্রাসী চক্রটি।
এভাবেই মানবাধিকারের পক্ষে দাড়াতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নানা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। তবুও দাড়াতে হবে মানবাধিকারের পক্ষেই।

#রিপোর্টারের ডায়েরী#

লেখক: আযাদ আলাউদ্দিন
ব্যুরো চীফ- দৈনিক নয়াদিগন্ত

সর্বশেষ