২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বরগুনায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

বরগুনা প্রতিনিধি :: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে সাগর উপকূলীয় জেলার বরগুনার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে অর্ধশতাধিক জনপদ। করোনার কারণে থমকে যাওয়া অর্থনীতির মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ‘মরার উপর খরার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল বরগুনার সাধারণ মানুষ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের হানায় সর্বস্ব হারিয়ে এখন দিশেহারা। সবচেয়ে বেশী ক্ষতির শিকার হয়েছে মধ্য ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো। একটানা দেড় বছর যাবত করোনাজনিত কারণে কর্মহীন জীবন-যাপন, উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য সংকটে বিরাজমান ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও জেলে পরিবারের লাগাতার অভাব-অনটনের মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। সরকার মাঝেমধ্যে খাদ্য সহায়তা প্রদান করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। খাদ্যাভাবের পাশাপশি মাত্রাতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসে উৎসগুলো প্লাবিত হওয়ায় নদী তীরবর্তী এলাকায় নিরাপদ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে।

বরগুনা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত পায়রা, বিষখালী, বলেশ্বর ও খাকদোনের উত্তালতায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ৩৭টি স্থান বিধ্বস্ত হয়ে আড়াই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে বিপর্যস্ত হয়েছে ১৮ হাজার পরিবার। ভেসে গেছে তিন হাজারের বেশী পুকুর ও ঘেরের মাছ। জলোচ্ছ্বাসের তীব্র স্রোতের মুখে পড়ে ভেসে গেছে অসংখ্য হাঁস-মুরগী। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন লক্ষাধিক মানুষ। বেড়ীবাঁধকেন্দ্রিক সিংহভাগ পরিবার দুর্যোগের তিন-চারদিন অতিক্রান্ত হলেও চুলায় হাড়ি চড়াতে পারেনি তলিয়ে যাওয়ার কারণে। কাঁচা বাড়িঘর বিলীন হয়েছে দুই শতাধিক।

উপকুলীয় এলাকা বরগুনার বেশকয়েকটি স্থানে রক্ষা বাঁধ না থাকা ৩৭টি স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার বা পাঁচ ফুট পানি প্রবাহিত হওয়ায় তলিয়ে যায় লোকালয়সহ ফসলের ক্ষেত। জেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও ভরা পূর্নিমার প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জলোচ্ছ্বাসে বরগুনা জেলার ৫শ’ ৪৫ হেক্টর জমির বোরোধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮শ’ ৭৬ হেক্টর জমির রবিশষ্য। পানেরবরজ বিধ্বস্ত হয়েছে ২শ’ ৪৮ হেক্টর জমির বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দেব জানান, বরগুনায় ইয়াসের কারণে জলোচ্ছাসে ৬টি উপজেলায় ১,২৪৯ টি মাছের ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। যার আয়তন ৭৪ হেক্টর। প্রায় ৬০ মেট্রিকটন মাছ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে বলে তিনি জানান। যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। বেসরকারী হিসেব মতে মৎস্য সম্পদে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক বেশী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলেরা। মৎস্য সম্পদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বরগুনার পাথরঘাটা ও তালতলী উপজেলায়। এখানে ১১শ’ ৩৪টি মাছের ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। আমতলী উপজেলায় ২৪০ টি, বামনায় ১৭৪টি, বেতাগীতে ২শ’১১টি এবং বরগুনা সদর উপজেলায় ২শ’৮০টি ঘের ও পুকুরের মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বরগুনায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বাড়ির উঠানে বিরাজমান পানিতে পড়ে পাথরঘাটার আবুবকর (২), বেতাগীতে দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে ইমামুল (৭) নামে পানির স্রোতে ভেসে যায়। ঘন্টাখানেক পড়ে শিশুটিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। দুর্যোগে মাছ ধরতে গিয়ে প্রাণ হারায় বামনার নান্না জোমাদ্দার (৩৫)। প্রবল স্রোতের মুখে ঝাকিজাল ফেললে স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যায়। ঘন্টাখানেক পর অদূরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বঙ্গোসাগরের তীরবর্তী প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি ফকিরহাটের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা ও হরিণঘাটা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায় টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা ও হরিণঘাটা সমুদ্র সৈকতে লাগানো গাছ এযাবৎ যে কয়টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তাতে কমপক্ষে ২৫ হাজার গাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত বছর আম্পানের কারনে প্রায় ৪ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ বিলীন হয়ে গিয়েছে। আম্পানের পর ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তান্ডবে টেংরাগিরি বন, শুভসন্ধ্যা ও হরিণঘাটা বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর শুভসন্ধ্যায় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় জোছনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উৎসব ঘিরে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। তা ছাড়া প্রতিদিন হাজারো পর্যটক আসতো। সমুদ্রের মূল আকর্ষণ ছিল শুভসন্ধ্যা। বিভিন্ন দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে শুভসন্ধ্যা বিলীনের পথে। সিডর, আয়লা, নারগিস, মহাসেন, আম্পান, ইয়াসসহ বড় বড় দুর্যোগকে মোকাবেলা করেছে এই বনাঞ্চল। বনের কারণে রক্ষা পেয়েছে উপকূলবাসী। উপকুলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও সম্পদের রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করেছে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনি। ম্যান-গ্রোভ বন উপকূলকে সব সময় রক্ষা করে আসছে। আর সেই রক্ষাকবজই ইয়াসের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বনাঞ্চল থেকে বাঁচার জন্য হরিণ, শুকর, বানরসহ অন্যান্য বন্যপশু সাঁতরে তীরে এসে লোকালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। পাথরঘাটার চরলাঠিমারা গ্রামে একটি হরিণ কুকুরের আক্রমণে মারা গেছে।

নাজুক বেড়িবাঁধের কারণে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস উপকুলীয় জেলা বরগুনাকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করেছে। যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে তা অদূর ভবিষ্যতে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

বরগুনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার আলম জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আগেই বরগুনায় ২৯কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের চাপে এসব বাঁধ দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করে গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আমরা এসব ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করেছি।

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ ইতোমধ্যে আমরা করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা মজুদ আছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং পরিবারের তালিকা অনুযায়ী সহায়তা প্রদান করা হবে।

সর্বশেষ