৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘স্বপ্নদোষ’ কি এবং কেন হয় ? প্রতিকারের সহজ উপায়…

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

হেলথ ডেস্ক:  ‘স্বপ্নদোষ’ শব্দটা একটা অপশব্দ বা অপপ্রচার। স্বপ্ন কখনো দোষের হয় না, বা দূষিত হয় না। একটি মানব শিশু যখন শৈশব পেরিয়ে কৈশরে পা রাখে, তখন তার মধ্যে হরমোনাল কারণে বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনগুলোকে বলে সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল ক্যারেক্টারিসটিক বা দ্বিতীয় পর্যায়ের যৌন বৈশিষ্ট্য। রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে যে বীর্যপাত হয়, এটা একেবারেই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া।

ছেলেদের ক্ষেত্রে:

শারীরিক পরিবর্তন:

১. সিক্ত স্বপ্ন বা যৌন স্বপ্নঃ ঘুমের মধ্যে বীর্যপাত,

২. লিঙ্গ, অন্ডকোষ বড় হতে থাকে। অন্ডথলি নিচের দিকে ঝুলে যায়,

৩. দাঁড়ি গোফ, বগলে, তলপেটে বা লীঙ্গের গোড়ায় চুল গজানো,

৪. গলার স্বর বদলে যায়। চিকন স্বর থেকে মোটা হতে শুরু করে এবং

৫. পেশি বিল্ডআপ হতে থাকে।

মানসিক পরিবর্তন:

১. তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে, গোপনীয়তা পছন্দ করে।

২. তারা কারো শাসন মানতে চায় না।

৩. সহজেই রেগে যায় বা উত্তেজিত হয়ে যায়।

৪. বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অর্থাৎ মেয়েদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ/যৌনাকাঙ্ক্ষা অনুভব করে।

৫. আবেগের ভারসাম্যহীনতা থাকে। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না অনেকে। বাবা-মায়ের চেয়ে বন্ধু-বান্ধব বা প্রেমিক প্রেমিকাকে বেশি আপন মনে করে।

৬. অনেকে যৌনস্বপ্ন বা বীর্জপাত নিয়ে বা অন্যান্য বয়ঃসন্ধিকালের প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা করে এবং হতাশায় ভোগে। অনেকের মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়।

৭. যৌন ব্যাপারে বা মেয়েদের ব্যাপারে অতিরিক্ত জানার আগ্রহ জন্মে।

মেয়েদের ক্ষেত্রে:

শারীরিক পরিবর্তন:

১. মাসিক শুরু হয়। প্রতি মাসে ৫-৭ দিন যোনিপথ দিয়ে রক্ত যায়। একে বলে মিন্সট্রুয়েশন। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

২. বগলে বা যৌনাঙ্গে লোম গজায়।

৩. বিভিন্ন অঙ্গে ফ্যাট জমে। যেমন: স্তন, নিতম্ব।

৪. পেশি বিল্ডআপ হয়। তবে ছেলেদের মতো অত শক্ত নয়। তবে যে সকল মেয়েরা ভারি কাজ করে, তাদের মাংস পেশী পুরুষের মতোই শক্ত হয়ে উঠে।

মানসিক পরিবর্তন:

১. বৈচিত্র ভাবনা জাগে মনে। ঘর বাধার স্বপ্ন বুনে।

২. আবেগের প্রাবল্যঃ সহজেই কাউকে বিশ্বাস করে এবং খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।

৩. ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে।

৪. ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। গোপনীয়তা পছন্দ করে।

৫. সাদা শ্রাব বা মাসিক নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় ভোগে। একে বলে প্রি-মিন্সট্রুয়াল টেনশন।

তাহলে মোটাদাগে দেখা যাচ্ছে, ছেলেদের যৌনস্বপ্ন-বীর্যপাত আর মেয়েদের মাসিক এবং শারীরিক গঠনের পরিবর্তন ছাড়া বেশ কিছু বিষয়ে মিল আছে। যেমন: উভয়েরই আবেগের প্রাবল্য থাকে, উভয়ই বয়ঃসন্ধির প্রক্রিয়াগুলো ভয় পায়। এগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করে এবং মানসিক সমস্যায় ভোগে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, মেয়েরা তাদের মা, খালা, নানি, দাদিদের কাছে এই বিষয়গুলো কিছুটা সাহায্য পেলেও ছেলেরা বাবা, চাচা, মামা, বড় ভাই, কোথাও এগুলোর তেমন সাহায্য পায় না। এই জন্যই বোধ হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বয়ঃসন্ধিকালকে ‘সংকটকাল’ হিসেবে অবহিত করেছেন। কারণ এই সময় কেউ কিশোর-কিশোরীর মনের কথা বুঝতে পারে না।

আজকের এই লেখায় ছেলেদের বয়ঃসন্ধি ও প্রজণনতন্ত্র নিয়ে পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। যাই হোক, এবার একটু পুরুষ প্রজণনতন্ত্রের গঠন (এনাটমি) জানা যাক।

১. পেনিস:

এটা জন্ম থেকেই থাকে। এর মধ্যে থাকে বিশেষ ধরনের ইরেক্টাইল কোষ, যার মাধ্যমে এটা যৌন উত্তেজনায় উত্থান বা শক্ত হয়ে উঠতে পারে। এর মাঝ দিয়ে গেছে মূত্রনালি। পুরুষের এই মূত্রনালি দিয়েই একাধারে মূত্র এবং বীর্য নির্গমন হয়। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে মূত্রনালি এবং জণননালি আলাদা।

* পেনিসের আকার নিয়ে বিভিন্ন মিথ আছে। এর স্বাভাবিক আকার শরীরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছুই নেই।

২. অন্ডথলি এবং অন্ডকোষ:

পেনিসের নিচে কুচকানো চামড়ার থলি থাকে। একে বলে অন্ডথলি। এর ভেতরে থাকে অন্ডকোষ। অন্ডোকোষের মধ্যে তৈরি হয় শুক্রানু। এই শুক্রানু উৎপাদনের জন্য পেটের ভেতরের চেয়ে ২-৩ ডিগ্রি কম তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। এজন্য এটা পেটের বাইরে অন্ডথলির মধ্যে ঝুলে থাকে। বাম অন্ডকোষ, ডান অন্ডকোষ চেয়ে একটু নিচে থাকে। দুই অন্ডকোষের মাঝে একটা পর্দা (সেপ্টাম) থাকে। অন্ডকোষের গঠন অনেকটা মুরগির ডিমের মতো। এর নিচের দিকে প্রথমে যে নালি লাগানো থাকে, তাকে বলে এপিডিডাইমিস। এরপর লম্বা ভাস ডিফারেন্স। এসব জায়গায় শুক্রানু জমা থাকে।

দুই দিক থেকে দুইটা ভাস ডিফারেন্স এসে মুত্রনালির সাথে যুক্ত হয়। এই নালিপথগুলো দিয়েই শুক্রানু/স্পার্ম বাইরে নির্গমন হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, অন্ডকোষের ভেতরের জিনিসপত্র (সেমিনিফেরাস টিউবুল) তৈরি হয় মায়ের পেটে থাকতে মেসোডার্ম থেকে।

৩. বিভিন্ন গ্রন্থি:

প্রোস্টেট গ্রন্থি: এটা লিঙ্গের গোড়ার দিকে লিঙ্গকে ঘিরে থাকে এবং মলাশয় বা রেক্টামের সামনে একদম লেগে থাকে। এখান থেকে প্রোস্টেটিক ফ্লুইড বা রস আসে। বীর্যের তরল অংশের উপাদান।

সেমিনাল ভেসিকল: এটা মূত্রথলীর নিচে এবং প্রোস্টেটের পেছনে থাকে। এখান থেকেও বীর্যের তরল অংশ আসে।

বাল্বো-ইউরেথ্রাল গ্রন্থি: এটাও প্রোস্টেটের নিচে থাকে এবং বীর্যের রস তৈরি করে। তাহলে বুঝা গেল বীর্যের রসটা আসে মূলত এই তিন গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি থেকে। আমাদের মাথার মধ্যে পিটুইটারি গ্রন্থি থাকে। যেটা অন্য সব গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখান থেকে মূলত যৌন হরমোন তৈরি এবং নিঃসরণ ঘটানোর হরমোন আসে। এগুলোকে বলে গোনাডোট্রোপিন রিলিজিং হরমন (FSH, LH)। এগুলোর প্রভাবে পুরুষের অন্ডকোষের মধ্যে প্রতিনিয়ত শুক্রানু আর ওই তিন গ্রন্থিতে বীর্যের রস তৈরি হয়। তৈরি হয়ে এগুলো ওই নালী পথে জমা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই যখন একবার বীর্যপাত হয়, তখন আবারও শুক্রানু ও বীর্যরস তৈরি হতে থাকে। সহজ করে বলতে গেলে আমরা খাওয়া-দাওয়া করি। সেগুলো থেকে আমাদের মল এবং মূত্র তৈরি হয়। আমরা যখন সেগুলো ত্যাগ করি। আবারও সেখানে সেগুলো তৈরি হয়। ঠিক তেমনি বীর্য ত্যাগ করার পর আবারো শরীরে (অন্ডকোষ) বীর্য তৈরি হয়। যতক্ষণ শরীরে হরমোন ঠিক আছে এই প্রক্রিয়াগুলো চলতেই থাকে। এটাই স্বাভাবিক।

খুব পরিচিত কিছু প্রশ্নের উত্তর

১. যৌনস্বপ্ন বা সিক্তস্বপ্ন কতদিন পরপর হওয়া স্বাভাবিক?

– এটার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নাই। মাসে একবার হতে পারে, আবার প্রতিদিনই হতে পারে। কোনো কোনো মাসে নাও হতে পারে।

২. এক রাতে কি দুই বা ততোধিক যৌনস্বপ্ন ঘটতে পারে?

– হতেই পারে, এটা স্বাভাবিক।

৩. যৌনস্বপ্ন হলে পরদিন এত শরীর খারাপ এবং ঘুম ঘুম লাগে কেন?

– মানসিক কারণে। সমাজে বহু আগে থেকেই প্রচলিত আছে ‘স্বপ্নদোষ’ (পড়ুন যৌনস্বপ্ন) হলে শরীর খারাপ হয়ে যায়। শরীরের সব শক্তি বীর্যের সাথে শরীর থেকে বাইরে চলে যায়, যা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য এবং কুসংস্কার। যখনই কোনো কিশোরের যৌন স্বপ্ন হয়, সে অবচেতনভাবেই সেগুলো মনে বিশ্বাস করে এবং ভয় পায়।

৪. বীর্যপাত হলে কি রক্ত কমে যায় বা রক্ত থেকেই বীর্য তৈরি হয়?

– না। কখনোই না। রক্ত একটি যোজক টিস্যু আর শুক্রানু একটি জনন কোষ। রক্তের উৎপত্তি এবং শুক্রানু বা বীর্যের উৎপত্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে তৈরি হয়। এদের মধ্যে উৎপত্তিগত কোনোই সম্পর্ক নাই। বীর্যের সাথে কোনো প্রকার রক্তকোষ বা রক্তের উপাদান বেরিয়ে যায় না।

৫. বীর্যের সাথে কি ব্রেইনের কোষসমূহ (নিউরোন) বেরিয়ে যায়, বা যার বেশি বীর্যপাত হয় তার কি মেধা কমে যায়?

– না। কখনোই না। ব্রেইনের নিউরোনের উৎপত্তি এক্টোডার্ম আর শুক্রানুর উৎপত্তি ইন্টারমিডিয়েট মেজাডার্ম থেকে। এর মধ্যে দূরতম সম্পর্কও নাই। তবে যাদের বীর্যপাত বেশি হয়, তারা ভয় পায় বা দুশ্চিন্তায় বেশি ভোগে। ফলে তাদের মধ্যে মনোযোগের অভাব হয়। এটা মানসিক সমস্যা। একে বলে এটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডার। এর চিকিৎসা নিলে মনোযোগও ফিরে আসবে। ফলও ভাল করবে।

৬. প্রস্রাবের পর হালকা সাদা সাদা ধাতু আসে। এটা কি ধাতুক্ষয়? এর জন্য কী শরীর খারাপ করে?

– ধাতুক্ষয় বলে মেডিকেল সায়েন্সে কোনো শব্দ নেই৷ এটা একটা অপশব্দ, যা একটা নেতিবাচক ধারণা দেয়। সুতরাং এগুলো যত বলবেন, মনে ততই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। যে সাদা ফ্লুইডটা আসে, সেটা মূলত প্রোস্টেট থেকে আসে। প্রোস্টেট গ্রন্থিটা একদম রেক্টামের (মলাশয়) সামনে প্রায় লেগে থাকে। ফলে পায়খানা কষা হলে রেক্টাম, প্রোস্টেটের উপর চাপ দেয়। ফলে প্রোস্টেটিক ফ্লুইড বেরিয়ে আসে। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেজন্য পায়খানা নরম রাখতে হবে। বেশি বেশি পানি পান, প্রয়োজনে ইউসুব গুলের ভুসি বা ল্যাক্টুলোজ সিরাপ খেতে হবে। তাহলেই সমস্যা দূর হয়ে যাবে।

৭. আমার পায়খানা কষা নয়, তবুও কেন প্রস্রাবের সাথে ধাতু আসে?

-পায়খানা কষা না হলে হালকা পরিমাণে আসতে পারে। যখনই প্রাকৃতিক নিয়মে প্রোস্টেটে মধ্যে ফ্লুইড তৈরি হয় এবং জমে জমে ভরে যায় (মূত্রথলিতে মূত্র যেমন জমে, তেমন), সেটা বাইরে বের হয়ে আসতে চাইবে। প্রস্রাবের সময় এমন কি ঘুমের মধ্যে, বা এমনি এমনিই বাইরে বের হয়ে আসে। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ব্যাপার হল: মূত্রনালি বা মলাশয় ভরে গেলে সক্রিয় স্নায়ু সিগ্নালের কারণে আমরা বুঝতে পারি যে, এখন আমার প্রস্রাব-পায়খানার বেগ আসছে। বাথ রুমে যেতে হবে। কিন্তু এই প্রোস্টেটেটিক ফ্লুইড ভরে গেলে তেমন কোনো সিগ্নাল দেয় না। তাই আমরা টেরও পায় না। বিষয়টা স্বাভাবিক। তবে, লিঙ্গ উত্তেজিত বা এক্সাইটেড হলে আমরা এই সিগ্নাল পাই।

প্রশ্ন: ঘুম থেকে ওঠার পর দেখি লিঙ্গের মাথায় অথবা কাপড়ের সাথে সাদা ধাতুর মত কিছু লেগে আছে৷ অথচ আমার যৌনস্বপ্ন হয়নি। এটা কেন হয়?

– এটাই প্রোস্টেটিক ফ্লুইড, এমনিই হতে পারে। অনেক কিশোরই ভয়ে থাকে যে ঘুম থেকে উঠেই হয়ত দেখবে কাপড়ের সাথে কিছু লেগে আছে। এতে মোটেও ভয় পাওয়া উচিত নয়। এমন হলে করণীয় হলো, হাসিমুখে তা ধুয়ে ফেলে দৈনন্দিন কাজে মন দেওয়া।

প্রশ্ন: অনেকে অন্ডোকোষ হাত দিয়ে ধরে দেখে এবং একটা ছোট-বড় মনে হয়? আবার ব্যথাও করে। এটা কি সমস্যা?

– অন্ডকোষ সাধারণত দুইটা সমানই হয়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে হালকা ছোট বড় থাকতে পারে এটাও স্বাভাবিক। বারবার নাড়া বা চেক করা যাবে না। এ রকম চেক করতে থাকলে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। মনে হতে পারে ব্যথা হচ্ছে।

প্রশ্ন: আমি অন্ডকোষ ঘনঘন চেক করি না। তারপরও ব্যথা করে কেন?

– সবচেয়ে কমন হলো আঘাত। অজান্তেই আঘাত লাগার ফলে ব্যথা হতে পারে। এছাড়াও কিছু ইনফেকশন যেমন: এপিডিডাইমাটিস হলে ব্যথা হয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে টরশন (অন্ডকোষ প্যাঁচ খেয়ে উপরে উঠে যায়), মাম্পস রোগ হলে অন্ডকোষে প্রদাহ (অর্কাইটিস) হলে ব্যথা হতে পারে। এর জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে ওষুধ খেলে সেরে যাবে। আবার কিছু কিছু কিশোর সারাক্ষণ অহেতুক দুশ্চিন্তায় মত্ত থাকে যে, অন্ডকোষে জটিল কোনো রোগ হয়ে গেল, আর বাঁচবে না, আর বাবা হতে পারবে না। পুরোটাই বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রশ্ন: কেন ঘন ঘন যৌনস্বপ্ন হয়?

– যৌন বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তা করলে, পর্ণগ্রাফি বা চটি পড়লে, কিশোরদের মনোজগতে বিরাট প্রভাব পড়ে। অবচেতন মনে সেসব ছবি বা দৃশ্য বারবার ভেসে আসে। এই জন্য স্বপ্নেও ওগুলোই আসে এবং বীর্যপাত ঘটায়। এভাবে বীর্যপাত ঘটলেও সেটা স্বাভাবিক। ভয়ের কিছু নেই। তবে কিশোরদের মনজগতে অনেক ক্ষতি হয়। এই জন্য তাদের চিন্তার জগত, মন ও মনন সুন্দর রাখার জন্য নিয়মিত ভাল ম্যাগাজিন, ভ্রমণ কাহিনী, গঠনমূলক, সৃজনশীল লেখা পড়া, সিনেমা দেখা উচিত। এসব ক্ষেত্রে ছেলেরা বাড়ির বাইরে যত সময় কাটাবে, তত এগুলোর আসক্তি কম হবে। একা একা আবদ্ধ ঘরে এই চিন্তাগুলো বেশি আসে।

প্রশ্ন: হস্তমৈথুন কি খারাপ জিনিস? যারা বেশি হস্তমৈথুন করে, তারা কি পরবর্তীতে স্ত্রী সহবাস করতে ব্যর্থ হয়? বাবা হতে পারে না?

– প্রশ্নের ২য় অংশ থেকে উত্তর দিচ্ছি। বেশি হস্তমৈথুন করলেও স্ত্রী সহবাস সফলভাবে করা যায় এবং বাবাও হতে পারে স্বাভাবিকভাবেই। হস্তমৈথুন বেশি করলে সব ক্ষমতা শেষ, ব্যাপারটা কখনোই এমন নয়। হস্তমৈথুনের সাথে যৌন ক্ষমতার কোনো শারীরিক সম্পর্ক নেই। তবে মানসিকভাবে ব্যাপক সম্পর্ক আছে। প্রথম অংশের উত্তর দিচ্ছি। হস্তমৈথুন প্রত্যেকটি ধর্মে নিষিদ্ধ। এটা একটা পাপের কাজ। কারণ এর ফলে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন: কিশোরটি সব সময় হতাশ থাকে। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ফলে ধাতুক্ষয়, স্বপ্নদোষ ইত্যাদি অপশব্দ বা নেগেটিভ শব্দ বা ভুল তথ্যে প্রভাবিত হয়ে সে ভাবতে থাকে তার আর বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নাই। ভাবে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে গেল সে, ইত্যাদি। আর পাপের কাজ করলে তো সব সময় পাপ বোধ হবেই। তবে যৌনস্বপ্ন একদম স্বাভাবিক। এর সাথে পাপবোধও হওয়া উচিত নয়। তবে অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয় সূত্র ধরে বলবো, একইভাবে অতিরিক্ত যৌন চিন্তা করা উচিত নয়।

প্রশ্ন: আমি প্রচুর পর্ণোগ্রাফি দেখি। একদম আসক্ত। পড়াশোনাতেও মন বসে না। ক্লাসের মেয়েদেরকেও এখন ওই রকম পর্ণোগ্রাফির মেয়েদের মতো মনে হয়। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

– উপায় হলো: ডিটারমিনেশন এবং ব্যক্তিত্ব গঠন। আপনি চাইলেই নিজেই আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। অন্যান্য নেশাদ্রব্যের আসক্তির মতো কিশোর জীবনে এটাও একটা বড় আসক্তি। নিজের সুন্দর মনন ও ব্যক্তিত্ব গঠন করার জন্য নিয়মিত খেলাধূলা, ভালো বই পড়া, ভালো বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, যাদের সাথে থাকলে গল্প গুজবের মূল প্রতিপাদ্য থাকে (future plan, career plan) কিভাবে অনেক বড় হওয়া যাবে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে, সৎ পথে অনেক আয় রোজগার করা যাবে? থাকে ইনকাম, সেভিং, ইনভেস্টমেন্টের চিন্তা, ইত্যাদি। যাদের ফোকাস থাকবে সামনের দিকে। যাই হোক, এটা একেবারে বের হয়ে আসা হয়ত অনেক সময় সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মনোরোগ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এখন মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ এরকম অনেক রোগী পাচ্ছেন। তারা সঠিক কাউন্সিলিং এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠছে।

প্রশ্ন: আমার সব সময় শরীর দুর্বল লাগে। মনে হয় না জানি কি জটিল রোগ হয়ে গেল, কী করবো?

– সত্যি সত্যিই আপনি অপুষ্টিতে ভুগতে পারেন। এজন্য ডিম, দুধ, মাছ মাংস, শাক সবজি, ফলমুল প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে। আর অপুষ্টিতে না ভুগলে, এই সমস্যাকে বলে ফোবিয়া। এর জন্য মনোরোগ ডাক্তার দেখান।

প্রশ্ন: আমার খুব মুড উঠানামা করে। এই ভাল আছি তো, হঠাৎ করেই খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে সবাইকেই অসহ্য লাগে। কি করবো?

– একে বলে মুড সুইং। কিশোর বয়সে এটা খুবই হয়। মনোরোগ ডাক্তারকে দেখান। আশা করি, ঠিক হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: আমার অন্ডথলি আগের চেয়ে বেশি ঝুলে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তা ও ভয় কাজ করছে। কী করবো?

– কিছুই করতে হবে না। শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণের সময় অন্ডথলিটা বড় হতে থাকে যাতে করে অন্ডকোষ এবং অন্যান্য নালি, রক্তনালী, স্নায়ু এগুলো পর্যাপ্ত জায়গা (স্পেস) পায় বড় হবার জন্য। সুতরাং এটা পুরোটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ভয়ের কিছু নেই। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: অন্ডথলি বেশি ঝুলে যাচ্ছে বলে অনেকে টাইট আন্ডারওয়ার পরার পরামর্শ দিচ্ছেন। এটা কতটুকু যৌক্তিক?

– মোটেও যৌক্তিক নয়। এতে করে অন্ডকোষের রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘক্ষণ পরে থাকলে সেখানকার তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং স্পার্ম উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই স্বাভাবিক আরাম দায়ক আন্ডারওয়ার ব্যবহার করা উচিত।

প্রশ্ন: আমার অন্ডকোষের উপরে কেচোর মত কি যেন বুঝা যায়। এটা কি?

– একে বলে ভেরিকোসিল। এটা হল অন্ডকোষের শীরাগুলো ফুলে ওঠা এবং একে বেঁকে প্যাঁচ খাওয়া। এর ভাল চিকিৎসা আছে। ভয় নেই।

প্রশ্ন: ক্রিকেট বল লাগে অন্ডকোষে। প্রচুর ব্যথা হয়। ফুলে যায়। এ থেকে বড় ক্ষতি কিছু হতে পারে? বাবা হতে সমস্যা হবে?

– না। খুব ব্যথা হলে ডাক্তারের পরামর্শ মতে ব্যথা নাশক ওষুধ খেতে হবে। এ ধরনের আঘাতের ফলে তেমন কোনো ক্ষতি হয়। বাবা হতেও কোনো সমস্যা হয় না।

প্রশ্ন: অন্ডথলির চামড়া প্রচণ্ড চুলকায়। কি করবো?

– অন্ডথলির চামড়া কুচকানো বা ভাজভাজ। যে কারণে এখানে প্রচুর ঘাম হয় এবং ছত্রাক জমে। নিয়মিত গোসলের সময় সাবান দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত। না হলে ছত্রাকের সংক্রমণ (ফাংগাল ইনফেকশন) হয়। কুচকিতেও হতে পারে। হয়ে গেলে এন্টিফাংগাল মলম/ক্রিম ব্যবহার করতে হয়। মুখে ওষুধও লাগতে পারে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

প্রশ্ন: কত দিন পর পর যৌনাঙ্গের লোম পরিষ্কার করা উচিত? এতে কি ব্যবহার করলে ভাল হয়। হেয়ার রিমুভার কি ব্যবহার করা যাবে?

– সাধারণত মাসে একবার পরিষ্কার করা উচিত। বর্তমানে ভাল রেজার পাওয়া যায়। যেমন: জিলেট গার্ড। এটা দিয়ে লোম কাটলে অন্ডকোষ বা লিঙ্গ কেটে যাওয়ার ভয় কম থাকে। সময় নিয়ে পরিষ্কার করা উচিত। তাড়াহুড়ো করা মোটেও উচিত নয়। আর হেয়ার রিমুভার ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে অন্ডথলি ও পেনিসের চামড়ার ক্ষতি হতে পারে।

প্রশ্ন: যৌনস্বপ্ন নিয়ে আমি পড়াশোনা করতে চাই। কি বই পড়বো?

– এই বিষয়ের উপর বেশ কয়েকজন ডাক্তারের লেখা বই আছে। রকমারি.কম এ খোঁজ করতে পারেন।

প্রশ্ন: ঘন ঘন যৌন স্বপ্ন হলে নাকি যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়। এটা কি ঠিক?

– না। মোটেও ঠিক নয়।

প্রশ্ন: বেশি বেশি হস্তমৈথুন করলে নাকি যৌন স্বপ্ন কম হয়। এটা ঠিক?

– হ্যাঁ। এ রকম হতে পারে। কারণ হস্তমৈথুনের ফলে কৃত্রিমভাবে একজন কিশোর তার বীর্যপাত ঘটাচ্ছে। ফলে বীর্য (শুক্রানু+বীর্যরস) তৈরি হতে সময় লাগে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তথা যৌনস্বপ্ন হবার আগেই যদি সে আবারো কৃত্রিম বীর্যপাত (হস্তমৈথুন) ঘটায়, তাহলে তো যৌনস্বপ্ন হবে না। বিষয়টা হল কলসি ভরার আগেই আপনি পানি ফেলে দিচ্ছেন। তবে এটাও স্বাভাবিক। ভয় পাবার কিছুই নেই।

প্রশ্ন: অনেকে বলে ঘন ঘন যৌনস্বপ্ন বা হস্তমৈথুনের ফলে বীর্য পাতলা হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে আর বাবা হওয়া যায় না। এটা কি ঠিক?

– মোটেও ঠিক নয়। বীর্য পাতলা বলে মেডিকেল সায়েন্সে কিছুই নেই। পাতলা বলতে যদি বুঝানো হয়, শুক্রানুর পরিমাণ কমে যাওয়া; তাহলেও বিষয়টা ভুল। কারণ অধিক হস্তমৈথুন বা অধিক যৌন স্বপ্নের ফলে কখনই শুক্রানুর পরিমাণ কমে না। শুক্রানুর পরিমাণ কমার (অলিগোস্পার্মিয়া) কারণ হল হরমোনাল, জন্মগত ত্রুটি, ভেরিকোসিল, বিভিন্ন ইনফেকশন (বিশেষ করে ভাইরাস), আঘাত, টিউমার, বিভিন্ন ওষুধ, উচ্চ রক্তচাপ, গাজা সেবন, মদ খাওয়া, বেশি ওজন, পকেটে বেশিক্ষণ মোবাইল রাখা, বা কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে নিয়মিত দীর্ঘক্ষণ কাজ করা ইত্যাদি।

প্রশ্ন: আমার সব সময় প্রজণনতন্ত্র নিয়ে চিন্তা হয়। ভয় লাগে। কী কী হলে ধরে নেবো, আমি একদম স্বাভাবিক আছি?

– প্রথমত, পৃথিবীতে সবাই-ই স্বাভাবিক। খুবই কম সংখ্যক মানুষ আছে, যারা জন্মগত ক্রোমোজোমাল বা হরমনাল সমস্যায় ভোগে। তাই শুরুতেই আপনাকে মানতে হবে, আপনি একদম স্বাভাবিক। কোনো সন্দেহ নাই। এ ছাড়াও মাসে বা দুই মাসে অন্তত যৌন স্বপ্ন হলে, প্রস্রাবে জালা পোড়া না থাকলে, প্রস্রাবের রাস্তায় পুজ না এলে, অন্যান্য সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল বৈশিষ্ট্য ঠিক থাকলে আপনি একদম স্বাভাবিক।

প্রশ্ন: ছোট বাচ্চা যেমন: সাত বছরের বাচ্চারও প্রস্রাবের সাথে সাথেই সাদা ধাতু আসে। এটা কোনো যৌন সমস্যা? পরবর্তীতে বড় কোনো সমস্যা হবে?

– না। এটা কোনো যৌন সমস্যা নয়। এটা কিডনির একটা সমস্যা, যার নাম নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম। এর ফলে কিডনি দিয়ে প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন বের হয়ে যায়। ফলে প্রস্রাবের রঙ সাদাটে হয়ে যায়। বাচ্চাকে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। অন্যথায় কিডনির বড় রকমের ক্ষতি হতে পারে। তবে যৌন ক্ষতি না।

প্রশ্ন: লিঙ্গের আকার নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখা যায়, এটা কতটুকু যৌক্তিক?

– মোটেও যৌক্তিক নয়।

প্রশ্ন: ঘন ঘন হস্তমৈথুন করলে কি লিঙ্গের কত ক্ষতি হয়?

– বড় কোনো ক্ষতি হয় না। তবে অনেক সময় লিঙ্গের চামড়া ছিলে যায়। জ্বালা পোড়া করে, ব্যথা হয়। যারা দীর্ঘদিন হস্তমৈথুন করে তারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। কোনো কাজে উৎসাহ পায় না। আর সবসময় পেনিসের কী ক্ষতি হয়ে গেল, একে বেঁকে গেল কি না, আগা মোটা, গোড়া চিকন ইত্যাদি অহেতুক দুশ্চিন্তায় ভোগে। তাই এটা শরীরের জন্য মোটেও ভাল কিছু নয়। এটা পরিহার করা উচিত।

আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে ভাল হতো। শেষে শুধু একটাই কথা, আমাদের দেশে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে যত সমস্যা হয়, তার বেশিরভাগই মানসিক। শারীরিক সমস্যা খুবই কম সংখ্যক পাওয়া যায়৷ এজন্য দায়ী আমাদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা এবং কুসংস্কার। বিভিন্ন আদিম যুগের কল্পনাপ্রসূত অপশব্দের ফলে কিশোর-কিশোরীদের মনোজগতে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আধুনিক যুগের মানুষ হিসেবে বিজ্ঞানকে জানতে হবে, মানতে হবে। প্রয়োজনে নিজে পড়তে হবে। বুঝতে না পারলে শিক্ষক বা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে। কোনো প্রচলিত অপশব্দ, কু-শব্দ, কুসংস্কার যেন আর একটি ছেলে-মেয়ের বাড়ন্ত-ছুটন্ত স্বাভাবিক আনন্দময় বয়ঃসন্ধিকালকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে। এজন্য পরিবার ও সমাজের সবাইকেই সচেতন হতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক মানসিক, মন-মনন যেন সুন্দর, স্বাভাবিক, সৃজনশীলতায় ভরে যায়, সেই প্রত্যাশায় শেষ করছি।

 

 

মেডিভয়েস

সর্বশেষ