১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বরিশাল নগরীর অবহেলিত ‘ছিটমহল’ চর জাগুয়া

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

অনলাইন ডেস্ক :: বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ডের আওতাধীন চর জাগুয়া একটি অবহেলিত ‘ছিটমহল’। এটি নগরীর অংশ হলেও সেখানে যাওয়ার সহজ কোনো পথ নেই। বেশ খানিকটা ঘুরে ঝালকাঠির নলছিটি হয়ে সেখানে যেতে হয়। নলছিটি উপজেলার চর জাগুয়া গ্রামটিই বরিশাল নগরীর অংশ। বেশ কয়েক বছর আগে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়া বরিশাল সিটির ‘ছিটমহল’ চর জাগুয়া।

বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা কালিজিরা। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ডের কালিজিরা বাজার থেকে ছাড়ে চর জাগুয়া যাওয়ার ট্রলার। সেখানে যেতে দুটি নদী পাড়ি দিতে হয়। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ সুগন্ধা নদীতে একটি ট্রলার দিলেও সেটি ঠিকমতো চলে না। ট্রলার ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা হয়। আলোর নিচেই অন্ধকারের মতো অবহেলিত ছিটমহলের ৫২ পরিবারের প্রায় ৫০০ মানুষ।

চর জাগুয়ার বাসিন্দারা জানান, ‘আগে এটুকুও ছিল না। বৈঠার নৌকায় চেপে উত্তাল সুগন্ধা পাড়ি দিয়ে বরিশালে আসত চর জাগুয়ার মানুষ। মেয়র হওয়ার পর সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এখানকার মানুষের সুবিধার্থে একটি ট্রলার দেন। কথা ছিল যতবার দরকার ততবার আসা-যাওয়া করবে ট্রলারটি। বিনিময়ে পাবে প্রয়োজনীয় তেল আর মাসে ৯ হাজার টাকা। বিনা পয়সায় নদী পার হবে চর জাগুয়ার মানুষ।

স্থানীয় এক যুবলীগ নেতাকে দেয়া হয় ট্রলার পরিচালনার দায়িত্ব। মেয়রের এ উদ্যোগে অবশ্য পানি ঢেলে দিয়েছে ট্রলার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সেই নেতা। চর জাগুয়ার মানুষের প্রয়োজন থাকলেও ট্রলার চলে পরিচালকের ইচ্ছেমতো। দিনে মাত্র দু’বার আসা-যাওয়া করে এই ট্রলার। ফলে জরুরি প্রয়োজনে মেলে না নদী পারাপারের সুবিধা। বিষয়টি নিয়ে একবার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন স্থানীয়রা। বিনিময়ে মিলেছে হুমকি। তাই তারা এ নিয়ে এখন আর কোনো উচ্চবাচ্য করেন না।

ট্রলারে চেপে বিশাল সুগন্ধা পাড়ি দিতে লাগে প্রায় ২০ মিনিট সময়। পাড়ে উঠতেই চোখে পড়ে শান্ত শ্যামল একটি গ্রাম। সুড়কি ওঠা সড়ক। নেই সড়কবাতি। বছর খানেক আগে বিদ্যুৎ সংযোগ লেগেছে। সন্ধ্যা হতেই অন্ধকার নেমে আসে পুরো গ্রামে।

চারদিকে ঝোপ-জঙ্গল। গ্রামে বছরজুড়ে থাকে চোর-ডাকাতের উৎপাত। বাসিন্দারা ভোগে নিরাপত্তাহীনতায়। মাঠ, খাল, পুকুর থাকলেও নেই খাবার পানির ব্যবস্থা কিংবা স্যানিটেশন। একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তা নিয়েও নানা অভিযোগ বাসিন্দাদের। গ্রামটিতে নাগরিক সুবিধার ছিটেফোঁটাও নেই।

দপদপিয়া সেতু আর ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সড়ক ধরে চর জাগুয়ায় যেতে হয়। নগর থেকে সরাসরি যেতে সুগন্ধা আর মরা কুমারখালী নদী পার হতে হয়। পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ তিন দিক দিয়ে চর জাগুয়াকে ঘিরে রেখেছে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা। উত্তরে সুগন্ধা আর মরা কুমারখালীর ওপারে সিটি কর্পোরেশন।

চর জাগুয়ার সবচেয়ে প্রবীণ বাসিন্দা মতিউর রহমান বলেন, ‘আগে আমরা ছিলাম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার জাগুয়া ইউনিয়নে। হঠাৎ শুনি আমাদের সিটিতে নিয়েছে। চাষাবাদ করে জীবন চালাতাম। তখন খাজনা দিতাম কাঠায় ৮ টাকা। এখন কর্পোরেশনে গিয়া খাজনা দিই কাঠায় ৫০ টাকা। তয় আগে শহরে যাইতে নৌকা পাইতাম না। সাদিক মেয়া একটা ট্রলার দিয়া অনেক উপকার করছে।’

মতিউর আরও বলেন, ‘কীভাবে আমরা সিটির মধ্যে গেলাম, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। মাঝখানে এত বড় নদী রেখে তারা আমাদের কী করে সিটিতে নিল? আমাদের এলাকাকে বর্ধিত এলাকা বলা হয়। এ এলাকা বাড়ানোর সময় তারা কেন সরেজমিন দেখে নিল না।’ তার এ প্রশ্নের জবাব মেলে না।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০২ সালের ২৫ জুলাই পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হওয়ার আগে পৌর এলাকার আয়তন ছিল মাত্র ২৫ বর্গকিলোমিটার। নগরে রূপান্তরের সময় এ আয়তন বাড়িয়ে ৪৫ বর্গকিলোমিটার করেন তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা। সরেজমিন না দেখে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ম্যাপের কাটাকুটিতে বেড়ে যাওয়া এ আয়তনে ঢুকে যায় বহু গ্রাম আর পল্লী। বর্ধিত এলাকা হিসেবে পরিচিত সেসব এলাকার মধ্যে চর জাগুয়াকে বলা হয় সবচেয়ে অভাগা।

দীর্ঘ প্রায় ১৯ বছরেও সেই দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি মেলেনি গ্রামের মানুষের। ভোট এলেই শুধু এখানে আসেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। শোনান উন্নয়নের আশ্বাস বাণী। ভোট ফুরোলে ফুরিয়ে যায় তাদের যাতায়াত।

২৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে উন্নয়ন বরাদ্দ। প্রয়োজনীয় অর্থ পেলেই চর জাগুয়ার উন্নয়ন কাজে হাত দেয়া হবে।’

চর জাগুয়ায় এখন তেমন কোনো সমস্যা নেই দাবি করে কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ওখানে উন্নয়নের বেশি কিছু বাকি নেই। একটি সেতু আর একটি রাস্তা সংস্কার করতে হবে। টেন্ডারের কাজ শেষ। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু হবে।’

উন্নয়নের এমন আশ্বাস বহুবার শুনলেও দেখা কখনোই মেলেনি জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা শিউলী বেগম বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাসিন্দা আমরা। কিন্তু সিটির কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। আমরা অনেক কষ্টে আছি। কোনো সাহায্য কেউ দেয় না। সবাই বলে শুধু সিটির বাসিন্দা। কিন্তু কোনো উপকার নাই তাতে। কাউন্সিলর, মহিলা কাউন্সিলর কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নেয় না।’

বাসিন্দা সরোয়ার হোসেন ফারুক বলেন, ‘আমরা সব কিছুতেই সমস্যায় আছি। পানি পাই না, রাস্তা নাই। যাতায়াতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জীবন শেষ হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘হয় আমাদের নলছিটির ভেতরে দেয়া হোক, নয় নাগরিক সুযোগ বৃদ্ধি করা হোক। সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু একজন নাগরিকের যে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য, তা পাচ্ছি না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করতে কষ্ট হয়। অনেক দূরে গিয়ে পড়তে হয় স্কুল-কলেজে।’

বাসিন্দা মিলন বলেন, ‘অনেক বছর আগে এখানে একটি সেতু ছিল। তাতে সহজে আমরা খেয়াঘাট পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারতাম। কিন্তু বালুর জাহাজ ধাক্কা দিয়ে সেতুটি ভেঙে দিয়েছে। এখন অনেক বেকায়দায় আছি। খেয়াঘাটে যেতেও বেশ খানিকটা পথ ঘুরতে হয়। সেতুটি হলে আমাদের অনেক সুবিধা হতো।’

গ্রামটিতে একটি মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১২৩নং চর জাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির করোনার কারণে বন্ধ। বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য সরকারের দেয়া টিউবওয়েলটিও বেহাত হয়ে গেছে। সেটির হ্যান্ডেলসহ মাথা খুলে মোটর বসিয়ে পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করছেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির এক আত্মীয়।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক মরিয়ম বেগম বলেন, ‘মোটর যাতে চুরি না হয়, সে কারণে আরেকজনের ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে।’ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোনাব্বর খান বলেন, ‘টিউবওয়েল সরিয়ে ফেললেও স্কুলের বাচ্চারা ঠিকমতোই পানি পাচ্ছে। যাদের ঘরে টিউবওয়েল থেকে পাইপ নেয়া হয়েছে তারা স্কুলে পানি সরবরাহ করে।’

সর্বশেষ