৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সত্য সংবাদ লিখতে কেন ভয় সাংবাদিকদের?

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

মামুনুর রশীদ নোমানী : সাংবাদিকদের কাজই সংবাদ লেখা। সেই সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হবে গণমাধ্যমে। এটাই সহজ সরল কথা। তবে আজ সাংবাদিকরা সংবাদ লিখতে ভয় পায়। চোর যদি চুরির মালামাল নিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয় তাও লিখতে ভয়। কারন অনেক। সবচেয়ে সাংবাদিকদের সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে বড় বাধাঁ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বেশ কয়েকটি আইন। আইনের বেড়াজালে সাংবাদিকরা আটকে গেছে। ফলে ভালোবাসা,পরীমনি আর বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনের সংবাদ লেখা ছাড়া উপায় নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে স্পস্ট উল্লেখ রয়েছে যে,

“(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।
(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে

(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং

(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।”

৩৯ নং অনুচ্ছেদের ১ এর “খ ” আজ মানা হচ্ছেনা। সংবাদক্ষেত্রের কোন স্বাধীনতা নেই। সাংবাদিকদের নিপিড়ন -নির্যাতন করা হচ্ছে সেই সাথে কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জামিন অযোগ্য মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়ে হয়রানী করা হচ্ছে।

প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে এমন কতকগুলো আইনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা : ১.) পেনাল কোড ১৯৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি); ২.) ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪); ৩.) অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩; ৪.) আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩; ৫.) প্রিন্টিং প্রেস ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩; ৬.) প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; ৭.) সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন, ১৯৭৪; ৮.) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ৯.) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮; ১০.) ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন, ২০২১; ১১.) ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্ট বেজড্ সার্ভিস প্রভাইডিং অ্যান্ড অপারেশন পলিসি, ২০২১ (আইসিটি বিভাগ দ্বারা); এবং ১২.) (খসড়া) ম্যাস মিডিয়া কর্মচারী (পরিষেবার শর্তাবলি) আইন ২০২২।

মানহানির আইনটি যে কেবল অহরহ ব্যবহৃত হয়, তা-ই নয়; এই আইনটির অপব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। এই আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, শুধুমাত্র মানহানির শিকার হয়েছেন এমনটি মনে করা ব্যক্তিই এই আইনে মামলা দায়ের করতে পারবেন এবং একাধিক মামলা দায়ের করা যাবে না। বাস্তবে দেখা যায় উল্টোটা। দেখা যাচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই যে কেউ এই ধরনের মামলা দায়ের করতে পারে এই দাবি করে যে, ‘আমার নেতার মানহানি হওয়ার কারণে আমার মানহানি হয়েছে।’ এই যুক্তিতে বা এই জাতীয় যুক্তিতে মামলার আবেদন করা হচ্ছে।

ট্র্যাজেডি হলো, নিম্ন আদালত এই সব মামলা গ্রহণ করছেন এবং একাধিক জায়গায় সেই মামলা নেওয়া হচ্ছে। ফলে সাংবাদিক/সম্পাদকদের দেশের বিভিন্ন জেলায় হাজিরা দিতে এবং আদালতের শুনানিতে অংশ নিতে এবং জামিন চাইতে দেখা যায়। সৌভাগ্যবশত, মানহানির মামলার ঘটনা কমেছে। তবে এই গত পরশুও ভোরের কাগজের সম্পাদক এবং প্রকাশককে একটি সন্দেহজনক মানহানির মামলার শিকার হতে হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং মুক্ত সংবাদমাধ্যমের ওপর এর বিধ্বংসী প্রভাব সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। এর ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো প্রতিদিনই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যা আমাদের সাংবাদিক এবং সম্পাদকদের টিকে থাকার জন্য সেল্ফ-সেন্সরশিপ বা স্বনিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করতে বাধ্য করছে।

সাংবাদিক নিবর্তনের নিরন্তর অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংস্থাগুলোর এ সংক্রান্ত অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, ‘কিছু বাড়াবাড়ি’ হয়ে থাকতে পারে। আমাদের আইনমন্ত্রী বলেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো সাংবাদিককে সরাসরি গ্রেপ্তার করা হবে না এবং প্রথমে তাঁদের তলব করা হবে। আমরা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়েছিলাম এবং আশা করেছিলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিটি থানায় এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেওয়া হবে। তবে আমাদের জানা মতে, এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ দেখা যায়নি।

এই মুহূর্তে, তিনটি খসড়া আইন পাইপলাইনে রয়েছে। এসব আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকি স্বরুপ ।

স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চা এখন বিশাল এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কোথাও কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা এমন আইন প্রণয়ন করছেন, যা কথা বলার অধিকার ক্ষুণ্ন করছে; কোথাও এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে যে, সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজ চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হলে সাংবাদিকদের জানা দরকার, আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে তাঁদের জন্য কী ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা৷ আমরা মনে করি এটা এখন খড়গের মতো চেপে আছে৷ বাংলাদেশে বিশেষ করে তৃণমূলে বহু সাংবাদিক এই আইনটির শিকার হচ্ছেন৷ গ্রেপ্তার হচ্ছেন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷ এই আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি৷ এই আইনে কখন কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হবে, কে গ্রেপ্তার হবে তা বলা যায় না৷’’

আইনটি করার সময় এর কিছু ধারার বিরোধিতা করেছিলেন সাংবাদিকরা৷ তখন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, কিছু ধারা সংশোধন হবে৷ এখন পর্যন্ত এই কুখ্যাত আইনটি সংশোধন বা বাতিল করা হয়নি।

আর্টিক্যাল-১৯ এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘‘(ডিজিটাল নিরাপত্তা) আইনটি করাই হয়েছে ভয় দেখানোর জন্য৷ যাদের প্রতিকার পাওয়া দরকার তাদের জন্য নয়৷ আইনের দরকার আছে৷ কিন্তু সেটা করতে হবে ভুক্তভোগীদের জন্য৷ আমাদের লন্ডন অফিস এই আইনের একটা বিশ্লেষণ করেছে৷ সেটা আমরা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘে পাঠিয়েছি৷ আমার ধারণা সরকার এটা নিয়ে জাতিসংঘের সাথে কথা বলছে৷ কিন্তু সরকার এরমধ্যে আরো দুইটি আইন করার কথা বলছে৷ একটি হলো স্যোসাল মিডিয়া কন্ট্রোল করার আইন৷ আরেকটি হলো ডিজিটাল ডাটা প্রটেকশন আইন৷ এই দুইটি আইনও সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যাবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলাগুলো হয়রানিমূলক৷ তাই যারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে তাদের শাস্তির জন্য আলাদা আইনের দাবী করছি আমরা৷’’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস এর প্রকাশিত গ্লোবাল ইমপিউনিটি ইনডেক্স বা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের দায়মুক্তি সূচকের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন৷ তাদের সদ্য প্রকাশিত ২০২১ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম৷ ফারুক ফয়সাল মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন তলানীতে৷’’

২০২১ সালের ২০ এপ্রিল ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২ তম, ২০২০ সালে যেটি ছিল ১৫১ তম৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ভিত্তিতে ২০০২ সাল থেকে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে৷ ২০১৩ সাল থেকে এই সূচকে বাংলাদেশ আছে৷ তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৪ তম৷ ২০২১ সালের প্রতিবেদনে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবার পেছনে৷ সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান (১৪৫), ভারত (১৪২), মিয়ানমার (১৪০), শ্রীলঙ্কা (১২৭), আফগানিস্তান (১২২), নেপাল (১০৬), মালদ্বীপ (৭৯), ভুটান (৬৫)৷ এই ধারবাহিক অবনমনের পেছনে গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের অদৃশ্যমান কঠোর নীতি, দমনমূলক আইন বিশেষ করে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার, সাংবাদিকদের ওপর পুলিশ ও বেসামরিক এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি দায়ী৷

বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র রাজধানীর চেয়ে রাজধানীর বাইরে বেশি ঘটেছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১) পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশে এক সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং ১৫৪ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আট জন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের দ্বারা ১৪ জন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৩ জন, হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালের ডাকা হরতালে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হন৷ এ ছাড়া ১০৬ জন সাংবাদিক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ ২০২১ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিক হয়রানির আরেকটি নতুন সংযোজন হলো সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে সেপ্টেম্বর মাসে ১১ সাংবাদিক নেতার তথ্য চায়৷
২০১৮ সালে প্রণীত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের নির্যাতনের জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন৷ আইনটি প্রণীত হওয়ার পর থেকে এটি প্রমাণিত যে, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হামলার চেয়ে মামলার শক্তি বেশি৷ আর্টিকেল নাইনটিন ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ২২৫টি মামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে৷ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৪১৭ জন ব্যক্তি এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৬৮ জন সাংবাদিক৷ এ সময় ১৫ জন সাংবাদিক এই আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ এ আইনে ২০২০ সালের মে মাসে গ্রেপ্তার হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় মারা যান৷ তার মৃত্যু আইনটির ভয়াবহতার কথা আরও একবার মনে করিয়ে দেয়৷ ‘৩০০ টাকা বরাদ্দে রোগী পায় ৭০ টাকার খাবার’- এমন খবর প্রকাশ করে জুলাই মাসে ঠাকুরগাঁওয়ের তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা হয়৷ এমনকি এই মামলায় অসুস্থ সাংবাদিককে হাতে হাতকড়া লাগাতে পিছপা হয়নি পুলিশ৷ আইনটি শুধু নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃতই হচ্ছে না, বরং এটি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে৷ ফলে সাম্প্রতিক সময়ে সেলফ-সেন্সরশিপ শব্দটি বাংলাদেশের সাংবাদিক মহলে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ৷ সম্পাদকেরা সংগত কারণেই জেল বা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঝুঁকি এড়াতে চান৷ ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বছরটিতে ক্রমেই খারাপ হয়েছে৷

চলতি বছর ২২ সালে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান । এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম। গত বছর এই অবস্থান ছিল ১৫২তম।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) তথ্য মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ভারত (১৫০), পাকিস্তান (১৫৭), শ্রীলঙ্কা (১৪৬), আফগানিস্তান (১৫৬), নেপাল (৭৬), মালদ্বীপ (৮৭) এবং ভুটান (৩৩)।

আরএসএফ বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে (ডিএসএ) ‘সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের অন্যতম কঠোর আইন’ বলে অভিহিত করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এটি (ডিএসএ) কোনো প্রকার পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের অনুমতি দেয়, যা সাংবাদিকদের সূত্রের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে এবং কোনো সাংবাদিক ‘নেগেটিভ প্রচারণা’ জাতীয় কিছু পোস্ট করলে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। এই আইনি পরিবেশে সম্পাদকরা নিয়মিত নিজেদের সেন্সর করে।’

সাবেক তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকা সম্পাদক মো. গোলাম রহমান বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের কারণে এই অবনতি হয়েছে। এই আইনের ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে এবং প্রকৃত বিচার হচ্ছে না। পুলিশ যে কাউকে এই আইনের অধীনে ধরে নিয়ে যেতে পারে।’

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পেছানোর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করেন গনমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

‘আরএসএফ মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে শতভাগ স্বাধীনতাকে বুঝায়। অর্থাৎ যেকোনো ব্যক্তি যা খুশি বলতে পারবেন। তাকে বাধা দেওয়া যাবে না। যদি কোনো এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপের বিভিন্ন কথাবার্তার জন্য তাদেরকে দমন করা হয় সেটি আমরা মনে করি ঠিক আছে। কিন্তু তাদের মতে, এটাকেও মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা বুঝায়।’

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে কেন ? ‘তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে আইনের ব্যবহার ঠিক মতো হচ্ছে না। এটা একটা কারণ হতে পারে।এখানে গণমাধ্যমের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন আরও কিছু নতুন আইন হচ্ছে। অন্য দেশগুলোতে এমন আইন নেই। তাই তারা এগিয়ে আছে।’

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা উল্লেখ করে মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আইনটি করার সময় দেশে ও দেশের বাইরে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। এখন সেই আইন ফল দিতে শুরু করেছে। গত ২৬ মাসে এই আইনে প্রায় ৯০০ মামলা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশ মামলাই হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। মামলাগুলো অধিকাংশ করেছে সরকারি দল বা তাদের সমর্থকরা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে। এর অপপ্রয়োগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।’

তিনি বলেন, ‘আইনটি তৈরির সময় এক মন্ত্রী বলেছিলেন, সবচেয়ে ভালো একটি আইন হচ্ছে। পৃথিবীর বহুদেশ নাকি এটিকে অনুসরণ করার জন্য বসে আছে। একজন ব্যক্তির ভূমিকার জন্য একটি রাষ্ট্রের এমন বিপদ হবে, তা আমরা কেউ ভাবতে পারিনি। তখন বলা হয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ত্রুটিগুলো সংশোধন করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সংশোধন করা হয়নি।’

তথ্য,সৃত্র :প্রথম আলো,ডয়েচে ভেলে,ইনকিলাব, বাংলাদেশ সংবিধান ,ডেইলী স্টার, জিআইজেএন।

লেখক : সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী, বরিশাল।

সর্বশেষ