২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা গলাচিপায় পঞ্চবটি আশ্রমে ৭দিন ব্যাপি মহানাম যজ্ঞ অনুষ্ঠিত তৃষ্ণার্ত মানুষদের বিশুদ্ধ পানি খাওয়ালো জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বাবুগঞ্জে পূর্ব শত্রুতার জেরে যুবককে মারধর ।। পাথরঘাটায় মৎস্য বিভাগের অভিযানে ‘মারধর’, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এক জেলে নিখোঁজ এফডিসিতে সাংবাদিকদের উপর হামলার প্রতিবাদে পিরোজপুরে মানববন্ধন রাঙাবালী তে সালাতুল ইসতিস্কার নামাজ ও দোয়া মোনাজাত পিরোজপুরে ভোটে অংশ নেওয়ায় দল থেকে বিএনপি নেতা বহিষ্কার অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না বরগুনায় বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী, জায়গা নেই হাসপাতালের মেঝেতেও

খোলামেলা বক্তৃতার কৌশল

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

মুহাম্মদ আবু হানিফ খান :

আজ আপনাকে বলব, জনসম্মুখে কীভাবে সাবলীলভাবে কথা বলবেন- সে সম্পর্কে। একজন জনপ্রিয় অনলবর্ষী বক্তা বা উপস্থাপক হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করতে, নিজেকে আকর্ষণীয়, গুরুত্বপূর্ণ, পছন্দনীয়, ব্যতিক্রমী, গ্রহণীয়, প্রিয়পাত্র, সম্মানিত এ রকম নানা অভিধায় পরিচিতি পেতে চাওয়া মানুষের এক সাধারণ প্রবৃত্তি। তবে শুধু মন চাইলেই হওয়া যায় না; প্রয়োজন নানা মুখী প্রচেষ্টা। জনপ্রিয় অনলবর্ষী বক্তা বা উপস্থাপক হতে চাইলে অন্যরা যা করেন আপনিও তা-ই করুন। তবে অন্যরা যেভাবে করেন আপনি ঠিক সে ভাবে না করে ভিন্নভাবে করুন। আপনার কথায় বা উপস্থাপনায় যতটা বৈচিত্র্য আনতে পারবেন, আপনি ঠিক ততখানি ব্যতিক্রমী আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। অন্যরা যা না জেনে আর না বুঝে করেন, আপনি তা ঠিকমত জেনে ও বুঝে করুন। অন্যরা যখন যান্ত্রিক ও ধরাবাধা পদ্ধতির চর্চাকারী হয়ে ওঠেন, আপনি তখন রোমান্টিক ও সৃষ্টিশীল হোন। মনোযোগী হোন, চর্চা করুন, অধ্যাবসায়ী হোন, নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে থাকুন। ফলে আপনি হয়ে উঠবেন জননন্দিত খ্যাতিমান বক্তা বা উপস্থাপক। মনে রাখবেন, পশু পাখি যেমন জন্মেই পশু-পাখি হয়, মানব সন্তান কিন্তু তেমন নয়। আকৃতিগত মানব সন্তানকে বৈশিষ্ট্যগত মানুষ হতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে হয়। একটি সুন্দর মুখের অসুন্দর কথার চেয়ে দেখতে অসুন্দর মুখের সুন্দর কথা হাজার গুণ বেশি দামী। তবে এই সুন্দর কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে যতসব বিপত্তি দেখা দেয় তার মধ্যে অন্যতম বিপত্তির নাম ভয়। দুর্দান্তভাবে এই ভয় নামক শত্রুকে পরাভূত করতে হবে সাহসিকতার সাথে।

ভয়কে ভয় না করে ভয়কে জয় করুন। উপস্থাপনাকালে মরুভূমির সাইক্লোনের মত বিপদজনক রূপ ধারণ করে সবার অলক্ষ্যেই আপনাকে বড় বিপদে ফেলতে পারে এই ভয়। যাকে আপনি দেখতে পাবেন না; তবে সবাই দেখতে পাবে আপনি যখন ভয়াক্রান্ত হবেন। ভয়কে পরাভূত করে করে জয় আপনার অর্জন করতেই হবে।
ভয় আপনাকে আঁকড়ে ধরার অন্যতম কারণ হল আপনি জনসম্মুখে নিজেকে উপস্থাপনার ব্যাপারে রীতিমত অনভ্যস্ত। ফলে ভয় এসে আপনাকে অক্টোপাসের মত আঁকড়ে ধরে। উপস্থাপনায় নবীন বা শিক্ষনবীশদের উচিত ভয় মোকাবেলায় ভড়কে না গিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আত্মবিশ্বাস ও সাহস নিয়ে ভয়কে মোকাবেলা করা। তবে এদের অবস্থা অনেকটাই শিক্ষানবীশ গাড়ী চালকের কম্পিত হাতের মত। এ জন্য চাই শারীরিক, মানসিক, জ্ঞান ও তথ্যগত আত্মবিশ্বাসপূর্ণ প্রস্তুতি। যুদ্ধক্ষেত্রে সার্বিক প্রস্তুতি আপনাকে সাহস যোগায় এবং পরাজয়ের ভয় হতে রক্ষা করে বিজয় এনে দেয়। প্রস্তুতির ব্যাপারে খ্যাতিমান উপস্থাপক ড্যানিয়েল ওয়েবন্টার বলেছিলেন, “অর্ধেক তৈরি হয়ে শ্রোতার সামনে যাওয়ার কথা ভাবলে মনে হয়, অর্ধেক পোশাক পড়ে হাজির হয়েছি”। উপস্থাপনায় ভয়কে জয় করার ব্যাপারে আমেরিকা’র এক সময়ের প্রেসিডেন্ট থিয়োডার রুজভেল্ট এর উপদেশ আপনি মানতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, “প্রত্যেকে কাজ করতে ভীত হয়। তাকে যা জয় করতে হবে তা হলো- ভয়ের কথা না ভেবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ ভাবেই একদিন তাকে জয় করা সম্ভব হবে”।

জনসম্মুখে কথা বলতে ভয় পাওয়ার সমস্যা শুধু আপনার একার নয়, বেশিরভাগ মানুষের। ভয়কে ভয় পাওয়ার ব্যাপারে আমি এমন কয়েকজন পদস্থ ব্যক্তির ব্যাপারে জানি, অনুষ্ঠানে হাজির থাকলে কথা বলতে হবে এই ভয়ে তারা অনুষ্ঠানে যোগদান হতে বিরত থাকতেন। এমনকি অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও তার কথা বলার পর্ব আসার আগেই কৌশলে অনুষ্ঠান স্থল ত্যাগ করতেন। তবে এঁদের কেউ কেউ আবার সময়ের ব্যবধানে বিখ্যাত বক্তাও হয়েছেন। ভয়কে জয় করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেরী করার জন্য তারা অবশ্য দুঃখিতও হয়েছেন। তবে ভয় পুরোপুরি ক্ষতিকর নয়; অনেকটা উপকারও দেয়। ভয় বেশি থাকা যেমন ক্ষতিকর তেমন একেবারে ভয়হীন থাকাও ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক। ভয় যেমন অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়, তেমন একদম ভয়হীনতা মানুষকে লাগামহীন, বেপরোয়া ও বেফাস করে তোলে। ভয়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে এমারসন-এর কথাটি মনে প্রাণে বিশ্বাস করার মত। তিনি বলেছেন, “পৃথিবীতে ভয়ের মত আর কিছু মানুষের এত বেশি ক্ষতি করে না”। বহু পেশাদার বিখ্যাত বক্তাও স্বীকার করেছেন, ভয়কে তারা পুরোপুরি জয় করতে পারেননি। তবে ভয় নিয়ে তাদের ভয় হয় না। ভয় তাদের নিয়ন্ত্রণে। একটু একটু ভয় থাকা আপনার জন্য উপকারীই বটে। এই নিয়ন্ত্রিত ভয় আপনার নাড়ী’র গতি বাড়ায়, আপনার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং আপনার কথায় উদ্দীপনা জোগায়। আর একদম ভয়হীন থাকলে কথা লাগামহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় কথা’র মূল্য হারায়, দর্শক-শ্রোতা মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সমর্থ হয় না। বরং বক্তাকে বাচাল ভাবতে শুরু করে।

মুখস্থ করে আসবেন না। মুখস্থ করার ব্যাপক পেরেশানী প্রকৃত খেই হারিয়ে দেয় উপস্থাপনার ক্ষেত্রে। মুখস্ত নয়; থাকা দরকার প্রস্তুতি ও চর্চা। এ সব না থাকলে উপস্থাপনাকালে ভয় বেশি আক্রমণ করে। প্রস্তুতির জন্য আপনার উপস্থাপনার বিষয় ভালভাবে রপ্ত করে আসবেন। তবে উপস্থাপনার কথাগুলো অক্ষরে-অক্ষরে মুখস্থ করে আসবেন না। মুখস্থ করার ফাঁদে পা দিবেন না। মুখস্থ করলে অযথা আপনার শক্তি ক্ষয় ছাড়া আর তেমন কোনো ফল বয়ে আনবে না। কাক ময়ূরের নাচ শিখেছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ ময়ূরের নাচ মনে রাখতে পারেনি। ফলে নিজের নাচও কাকের মন হতে হারিয়ে গিয়েছিল। মুখস্থ করা বিষয় ভুলে গেলে ময়ূরের নাচ শিখতে যাওয়া কাকের দশায় পড়তে পারেন আপনিও। মুখস্থ করা বিষয় আসে স্মৃতি থেকে, মন থেকে নয়। মনের কথা আর স্মৃতির কথা এক হয় না। মন থেকে না বললে দর্শক-শ্রোতা মন দিয়ে শোনেন না। বিষয়বস্তু মনেও রাখেন না। মনে রাখবে না আপনাকেও। বিরূপ পরিবেশে পড়লে মুখস্থ করা স্মৃতির কথা অনেকটাই হারিয়ে যেতে পারে।
এবার জানুন মুখস্থ করা বক্তৃতার পরিণতির কথা। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মেম্বর তরুণ বয়সী উইনস্টন চার্চিল। তিনি বক্তৃতা লিখে নিতেন এবং তা মুখস্থ করতেন। একদিন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মুখস্থ করা ভাষণ দিচ্ছিলেন। আচমকা তিনি সব ভুলে গেলেন। সব গোলমাল হয়ে গেল। তিনি বেশ হতচকিত হয়ে বসে পড়লেন। সেই অবধি তিনি মুখস্থ করা বক্তৃতা করতে ছেড়ে দিলেন। মুখস্থ করা বক্তৃতার পরিণতি অবগত হতে আরও একজনের অভিজ্ঞতার কথা জানুন। ইকুইটেবল লাইফ ইন্স্যুরেন্স আমেরিকার বড় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্স বুশনেল। অনেক বছর আগে দু’হাজার বিমা কর্মকর্তার সম্মেলনে কুড়ি মিনিট ভাষণ দানের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি বেজায় খুশি হলেন। এতে তার সুনাম ও পরিচিতি দু’টোই আরও বাড়বে। এ কাজের জন্য তিনি বক্তৃতা লিখলেন এবং ভালভাবে মুখস্থ করলেন। রীতিমত অনুশীলন করে চললেন। অন্তত ৪০বার আয়না’র সামনে দেখে নিলেন,তার বক্তৃতার প্রক্ষেপণ, চোখের দৃষ্টি, হাত-পায়ের ভঙ্গী, মাথা নাড়ানো সবকিছুই এখন একেবারে নিখুঁত লাগছে। দিনক্ষণও ঘনিয়ে আসলো। এবার বক্তৃতা প্রদান পালা। সময়মত তিনি মঞ্চে আরোহণ করলেন। কিন্তু এতো ভাবনার ফলে ওঠামাত্রই প্রচ- ভয় তাকে চেপে বসল। তিনি ডায়াসের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, “ভদ্র মহোদয়গণ! আজ এ অনুষ্ঠানে আমার কাজ হলো—”। ভদ্রলোক সব ভুলে গেলেন। আর মনে করতে পারছেন না। বহু কসরত করলেন। মনে করার নিরন্তর প্রচেষ্টা। একটু পেছনের দিকে এগিয়ে দ্বিতীয়বার আবার সামনে ডায়াসের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, “ভদ্র মহোদয়গণ! আজ এ অনুষ্ঠানে আমার কাজ হলো—”। কিন্তু এবারও আর মনে করতে পারছেন না। তৃতীয়বারও তিনি একই কাজ করলেন। বললেন, “ভদ্র মহোদয়গণ! আজ এ অনুষ্ঠানে আমার কাজ হলো ………”। রাগে, দুঃখে ও লজ্জায় ঘর্মাক্ত হয়ে গেলেন। মনে করার শেষ চেষ্টা হিসেবে এবার আরও একটু পেছনে আসতে চেষ্টা করলেন।

মঞ্চ ছিল চার ফুট উঁচু। পেছনে ছিল না রেলিং। ফলে যা হবার তাই হলো। তিনি যেই পিছিয়ে এলেন, সেই উল্টে পড়ে একদম অদৃশ্য হয়ে গেলেন। শ্রোতাগণ হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলেন। কারণ, জীবন বিমা’র ইতিহাসে এমন ঘটনা কেউ কখনও মনে করতে পারেনি। আবার কেউ-কেউ ভাবলেন, এতোবড় অনুষ্ঠানে এমন মজার দৃশ্য নিশ্চয়ই বিশেষ ধরনের অভিনয়। কিন্তু বক্তা ভান্স বুশনেল নিজেকে চরম ভাবে অপমানিত বোধ করলেন। ব্যর্থতার ক্ষোভ আর অপমান বোধে বেচারা পদত্যাগ পত্র লিখে ফেললেন। তবে, বিমা শিল্পে তার দক্ষতার কারণে উপর ওয়ালারা কোনোভাবে বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাঁকে নিরস্ত্র করতে সমর্থ হলেন। আব্রাহাম লিঙ্কন এ ব্যাপারে উপদেশ দিতে বলেছেন, “আমি কাউকে মুখস্থ করার উপদেশ শোনাতে দেখতে চাই না। আমি চাই, সে খোলামেলা ভাবেই বক্তৃতা করুক”। আপনার জয় প্রথমবারেই ধরা দিবে এমন আশায় বসে থাকা অনুচিত। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখুন যে, ব্যর্থতার উপরই আপনার সফলতার ভীত স্থাপিত হবে। তবে তা হয়তো একটু পরেই হবে। এ জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। এ জন্য চাই প্রচুর ধৈর্য্য। এ ক্ষেত্রে আপনি মাকড়শার নীতি অনুসরণ করুন।

যে কোনো আদর্শ বা মতবাদ প্রচারে চাই সাবলীল উপস্থাপন। শংকা ও জড়তাহীন উপস্থাপন উদ্দীষ্ট জনগোষ্ঠীকে দাওয়াত বা আদর্শ গ্রহণে অধিক প্রভাবিত ও প্রলুব্ধ করে। ইসলামের দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, আল্লাহর নবী হযরত মুসা আলাইহিস সালাম যখন ফেরাউনকে দাওয়াত দানে আদিষ্ট হলেন, তখন তাঁর নিকট দু’টো বিষয় বড় বাধা বলে প্রতিয়মান হয়েছিলো। একটি হলা- জড়তা, অপরটি হলো- ভয়। এ দুটো হতে মুক্তির জন্য তিনি আল্লাহর সাহায্য চেয়েছিলেন। আল্লাহর সাহায্য পেয়ে আদর্শ প্রচারে তিনি আশ্চর্য রকম ভাবে সফল হয়েছিলেন। আপনার জিহ্বাকে গতিশীল করতে কুরআন মাজীদে সূরা ত্বোয়া-হা-এ বর্ণিত এই দোয়া বেশি বেশি পড়–ন- ”রব্বি জিদনী ইলমা। রব্বিশ্রাহলী ছদরী ওয়াসসিরলি আমরী অহলুল উক্বদতাম-মিললিসানিহী ইয়াফকাহু ক্বওলি। রব্বি জিদনী ইলমান, ফাহমান কামিলান”।

লেখক: চেয়ারম্যান, ডিপার্টমেন্ট অব ম্যাস মিডিয়া অ্যান্ড জার্নালিজম, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা ।

সর্বশেষ