২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মহানবীর জীবনাদর্শের ওপর আমল করতে হবে

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

মাহমুদ আহমদ: পবিত্র এ রবিউল আউয়াল মাসেই বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠনবী, শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-কে এ পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা শান্তির অমিয় বাণী দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাই এ মাসে আমাদেরকে আরো বেশি মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা এবং নিজ জীবনে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা উচিত। আসলে শুধু এ মাসেই নয় বরং মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ আমাদেরকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণই আলোচনা করতে হবে এবং তার সুন্নতের ওপর আমল করে নিজ জীবন পরিচালনাও করতে হবে।

এই মহান রাসূল সম্পর্কে আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তার ফেরেশতারা এ নবীর প্রতি রহমত বর্ষণ করছেন, হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরাও তার প্রতি দরুদ পাঠ কর এবং তার জন্য বেশি বেশি করে শান্তি কামনা কর’ (সুরা আল আহযাব, আয়াত: ৫৬)। তাই প্রতিনিয়ত আমাদেরকে দরুদ শরীফ পাঠ করতে হবে। এই মহান রাসূলের অতুলনীয় আদর্শ ব্যাপকভাবে আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ইসলামে শত্রæদের পক্ষে এই আপত্তি করার সুযোগই না পায় যে, ইসলাম সন্ত্রাসীর ধর্ম, নাউযুবিল্লাহ। ইসলাম যে শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম এবং মহানবী (সা.) যে শান্তির দূত তা প্রাশ্চাত্যের সকলের কাছেও তুলে ধরতে হবে।

এ হাদিসটি পাঠ করলেই বুঝা যায় মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ কতই না উত্তম ছিল। হজরত সাঈদ বিন আবি সাঈদ (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.)-কে এ কথা বলতে শুনেছেন; রাসূল করিম (সা.) নজদ অভিমুখে যুদ্ধ অভিযান প্রেরণ করেন আর তারা বনু হানিফার এক ব্যক্তি সুমামাহ বিন আসাল’কে বন্দি করে নিয়ে আসেন। সাহাবিরা তাকে মসজিদে নববীর পিলারের সাথে বেঁধে রাখেন। মহানবী (সা.) তার কাছে এসে বলেন, হে সুমামাহ! তোমার কাছে কি অজুহাত আছে বা তোমার সাথে কি ব্যবহার করা হবে বলে তুমি মনে কর। সে বলল, আমার সুধারণা রয়েছে। যদি আপনি (সা.) আমাকে হত্যা করেন তাহলে আপনি একজন খুনিকে হত্যা করবেন আর যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এর মূল্যায়ন করতে জানে। কিন্তু যদি আপনি (সা.) সম্পদ চান তাহলে যত ইচ্ছে নিয়ে নিন। এভাবেই পরের দিবস উদয় হয়। তিনি (সা.) পরের দিন আবারো আসেন এবং সুমামাহ’কে জিজ্ঞেস করেন, তোমার সংকল্প কি? সুমামাহ বলেন, আমি তো গতকালই আপনার সমীপে নিবেদন করেছি, যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এ অনুগ্রহের মূল্যায়ন করতে জানে। তিনি এখানেই কথা বন্ধ করেন আর পরের দিন সূর্য উদয়ের পর পুনরায় বলেন, হে সুমামাহ তোমার নিয়ত কি? সে বলল, আমার যা কিছু বলার ছিল তা বলেছি। এ কথা শোনার পর তিনি (সা.) বলেন, একে মুক্ত করে দাও। সুমামাহ মসজিদের কাছে খেজুর বাগানে যায়, গোসল করে মসজিদে প্রবেশ করে কলেমা শাহাদত পাঠ করে বলে, হে মুহাম্মদ (সা.)! খোদার কসম, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার চেহারা আর বর্তমান অবস্থা এমন যে, আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার চেহারা। খোদার কসম পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার ধর্ম আর বর্তমান অবস্থায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার আনীত ধর্ম। খোদার কসম! পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম আপনার শহরকে আর এখন এ শহরই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আপনার (সা.) ঘোড় সওয়ারীরা তখন আমাকে ধরেছে যখন আমি ওমরাহ করতে চাচ্ছিলাম। এ ব্যাপারে আপনার নির্দেশনা কি? রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে শুভসংবাদ দেন আর তাকে ওমরাহ করার নির্দেশ দেন। যখন তিনি মক্কায় পৌঁছেন তখন কেউ বলল, তুমি কি সাবী হয়ে গেছো? উত্তরে সে বলল, না, আমি মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছি’ (বোখারি)। দেখুন, তিনি (সা.) তিন দিন পর্যন্ত তাকে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করার প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করেন যাতে সে মুসলমানদের ইবাদতের রীতি-পদ্ধতি ও নিষ্ঠা এবং আপন প্রভুর সমীপে কীভাবে অনুনয় বিনয় করে তা দেখতে পায় এবং মুসলমানরা মহানবী (সা.)-এর প্রতি কীভাবে ভালোবাসা ও প্রীতি প্রকাশ করে আর তিনি (সা.) তার মান্যকারীদেরকে কি শিক্ষা প্রদান করেন। মহানবী (সা.) তাকে সরাসরি ইসলামের কোনো তবলিগ করেননি। কেবল প্রত্যহ জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার সংকল্প কি? যাতে বুঝতে পারেন এর ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কি না এবং তৃতীয় দিন তার দিব্য শক্তি বুঝতে পেরেছে যে, এখন এর মধ্যে কোমলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই কোনো অঙ্গীকার ছাড়াই তাকে মুক্ত করে দেন তারপর যে ফলাফল সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ তার ইসলাম গ্রহণই প্রমাণ করে যে, তার (সা.) ধারণা সঠিক ছিল।

মহানবীর (সা.) ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম আর তিনি মোটা পাড়ের চাদর পরিহিত ছিলেন। একজন বেদুঈন এসে সেই চাদর ধরে এত জোরে হেঁচকা টান দেয় যার কারণে হুজুরের (সা.) গলায় চাদরের পাড়ের দাগ পড়ে যায়। এরপর সে বলে, হে মুহাম্মদ (সা.)! আল্লাহ প্রদত্ত এই সম্পদ দিয়ে আমার এই দুটি উট বোঝাই করে দিন কেননা আপনি আমাকে আপনার নিজস্ব সম্পদ থেকেও কিছু দিচ্ছেন না আর আপনার পৈতৃক সম্পদ থেকেও দিচ্ছেন না। এ কথা শুনে প্রথমে মহানবী (সা.) নিরব থাকেন এরপর বলেন, ‘আল মালু মালুল্লাহি ওয়া আনা আবদুহু’ অর্থাৎ সমস্ত সম্পদ আল্লাহরই আর আমি তার এক বান্দা মাত্র। এরপর তিনি (সা.) বলেন, আমাকে যে কষ্ট দিয়েছ তোমার কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেয়া হবে। সে বলল, না! মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, কেন প্রতিশোধ নেয়া হবে না? সে বলল, কেননা আপনি মন্দকে মন্দ দিয়ে প্রতিহত করেন না। এ কথা শুনে হুজুর (সা.) হেসে ফেলেন। এরপর মহানবী (সা.) নির্দেশ দিলেন, এর একটি উটে জব আর অপরটিতে খেজুর বোঝাই করে দাও’ (আল শিফাউল কাযী আয়ায, প্রথম খণ্ড)। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এই দৃষ্টান্তই মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, আর এই ব্যবহার শুধু আপনজনের সাথেই নয় বরং শত্রুদের প্রতিও তিনি প্রদর্শন করেছেন।

বর্তমানে আমাদের বিশ্ব যেসব বড় বড় সমস্যায় জর্জরিত এসব পরিস্থিতিকে যদি এক বাক্যে বলতে হয় তাহলে মৌলিক সমস্যা হলো, শান্তি উঠে যাওয়া আর এটি নিরসনে আজ পর্যন্ত যত চেষ্টা-প্রচেষ্টা করা হয়েছে তা ব্যাহত সবই ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে আর এখন ইউনাইটেড ন্যাশনসকে পর্যুদস্ত মনে হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। এমনকি পবিত্র মসজিদেও হামলা চালানো হচ্ছে আর এতে শত শত নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। সর্বত্রই আজ অশান্তি বিরাজ করছে। পুরো মানবজাতি আজ অস্থির, সবার আকাক্সক্ষা কীভাবে শান্তি নামের অমূল্য সম্পদ জুটবে। হ্যাঁ, এই শান্তি তখনই লাভ সম্ভব হবে যখন বিশ্ববাসী পবিত্র কোরআনে উপস্থাপিত শিক্ষামালা এবং মহানবী (সা.) এর আদর্শ অবলম্বনে জীবন পরিচালনা করবে।
রাসূল পাক (সা.)-এর কল্যাণমণ্ডিত পুরো জীবন এ বিষয়ের জীবন্ত সাক্ষী, তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার এক মহান মূর্তিমান আদর্শ হিসাবে জীবনযাপন করেছেন এবং চরম প্রতিক‚ল ও কঠিন পরিস্থিতিতেও শান্তির পতাকা উঁচু রেখে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, কোরআনি শিক্ষামালার ওপর আমল করলে পরেই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তার মাক্কী জীবনী এবং মাদানী যুগেও তার পুরো জীবনাদর্শ এমনসব ঘটনাবলিতে পরিপূর্ণ যে, কীভাবে রাসূল পাক (সা.) তার মান্যকারীদেরকে কোরআনের শিক্ষামালার কল্যাণে শান্তির মূর্তিমান প্রতীক বানিয়ে দিয়েছেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তিনি মুসলমানদের সামনে এক পরম সহানুভ‚তিপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ উত্তম নৈতিক আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। যুদ্ধের নাম নিলেই তো বর্তমান যুগের নাম সর্বস্ব সভ্য দেশগুলো নম্রতা, নৈতিক আচরণ, সহমর্মিতা এবং ন্যায়বিচারের সকল দাবি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যায় কিন্তু বিশ্বশান্তির মহানায়ক হজরত মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধ এবং হানাহানির ক্ষেত্রসমূহেও শান্তি এবং নিরাপত্তার উন্নত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে এমন অতুলনীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন যা সকল যুগে পুরো মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। মক্কা বিজয়ের দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে স্পষ্ট সাক্ষী। খুনি ও শত্রæদের ক্ষমা করে বিশ্ব ইতিহাসে সেই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত এর কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) সর্বদা এমন আদর্শ দেখিয়েছেন যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

এই শান্তির ধর্মে কোনো ধরনের বল প্রয়োগের শিক্ষা নেই। ইসলাম কাউকে হত্যা করার শিক্ষা দেয় না। কাউকে হত্যার ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা করা হবে তা হবে রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত’ (বোখারি)। কাউকে হত্যা করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে, শুধু নিষেধ করেই শেষ করে নাই বরং যারা এসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কার্যক্রম করে তাদের শাস্তি কত ভয়াবহ সে সম্পর্কেও অবহিত করা হয়েছে। ইসলামের শিক্ষা কত উন্নত যে বল প্রয়োগ করে ইসলামের প্রচার করতে পর্যন্ত বারণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা এবং শ্রেষ্ঠ নবীর আদর্শ মোতাবেক জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

সর্বশেষ