৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দক্ষিণবঙ্গের ‘বাতিঘর’ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

মুহাম্মাদ ইমাদুল হক ফিরদাউছ প্রিন্স

আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার, উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব প্রদানসহ গবেষণার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি ও কৃষি ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি দক্ষিণাঞ্চলের শীর্ষ বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়েছে। একইসঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি আশা-আকাঙ্খার প্রতীকও। দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে দক্ষিণবঙ্গের স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

২০০০ সালের ০৮ জুলাই তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলায় সাবেক পটুয়াখালী কৃষি কলেজের অবকাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। আগামী ৮ জুলাই ক্যাম্পাসটি নিজস্ব ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ২২ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রাগ্রসর অবদানের জন্য আজ দেশ-বিদেশে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। প্রাথমিকভাবে কৃষি, সিএসই ও বিবিএ ৩টি অনুষদে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় যা সময়ের পরিক্রমায় আজ ৮টি অনুষদের অধীনে (কৃষি অনুষদ, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ, বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুষদ, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, এ্যানিমাল সায়েন্স এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদ, নিউট্রিশন এন্ড ফুড সায়েন্স অনুষদ এবং ল এন্ড ল্যান্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুষদ) শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই ৮টি অনুষদের অধীনে ৯টি ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। ৮৯.৯৭ একর আয়তনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে স্নাতক পর্যায়ে ৩৬৯১ জন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৪৫১ জন এবং পিএইচডি পর্যায়ে ২৪ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত আছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাসের সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ভবনগুলোতে লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা।

শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৫৩ জন শিক্ষক, ১৮৩ জন কর্মকর্তা ও ৫২৯ জন কর্মচারী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা প্রদানের জন্য ৫টি ছাত্র হল এবং ৩টি ছাত্রী হল রয়েছে। সেশনজটমুক্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরী করার লক্ষ্যে নানাবিধ পরিকল্পনার কথা জানান বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বনামধন্য ভাইস-চ্যান্সেলর দেশ বরেণ্য কৃষি বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত। তিনি বলেন, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিপ্রবির কৃষি অনুষদের শিক্ষকগণ দেশের কৃষিতে সমৃদ্ধি আনয়নকল্পে ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এবং সফলও হচ্ছেন।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে একঝাঁক মেধাবী তরুণ শিক্ষকমণ্ডলী। তাদের পাঠদান বিশ্ববিদ্যালয়কে সমৃদ্ধ করছে। পবিপ্রবি একদিকে যেমন মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করছে, অন্যদিকে পিছিয়ে নেই সহশিক্ষা কার্যক্রমেও। ছাত্র-শিক্ষক অংশগ্রহণে বছরজুড়েই চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, বিভিন্ন অলিম্পিয়াড, বইমেলা, পিঠা উৎসবসহ নানা আয়োজন। যথাযথভাবে পালন করা হয় সব জাতীয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিবস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত অংশ নেয় আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মেধাবীদের গোল্ড মেডেল দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় প্রতিবারই এখানের কৃতী শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক লাভ করে। এটি আমাদের জন্য গৌরবের।

দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ শিক্ষালয় হিসেবে সুনামের সঙ্গেই এর অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। এ ক্যাম্পাসের হাজার হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশের সরকারী-বেসরকারী নানা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর পদে কর্মরত রয়েছে। এটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং গরিব পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য আদর্শ স্থান। বাস্তবিকভাবেই পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলা শহরের দৈনন্দিন খরচ অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় কম। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ব্যয়ও অস্বচ্ছল পরিবারের সামর্থ্যের মধ্যে রাখা হয়েছে। প্রায় সকল শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তারপরেও বরিশাল বিভাগীয় শহর এবং পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে আসা-যাওয়ার জন্য রয়েছে সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা। বর্তমানে পবিপ্রবি ডিজিটাল ক্যাম্পাসে পরিণত হয়েছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরীর জন্য আউটকাম বেইজড কোর্স-কারিকুলাম তৈরীর উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি এর মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে এ এলাকার বিভিন্ন প্রান্তিক চাষীদের চাষাবাদের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার, মৎস্যজীবীদের উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষ, মাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ, গবাদী পশু পালন ও চিকিৎসা সুবিধা প্রদান, খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা তৈরীর লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন ডিসেমিনেশন সেন্টার (পিআইডিসি) এর মাধ্যমে কৃষক ও যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়াও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সিএসই অনুষদ এবং কৃষি ব্যবসা ও বিপনণ ব্যবস্থপনার জন্য বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুষদ একত্রে কাজ করে চলছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে প্রায় ৮৪ টি গবেষণা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ সব গবেষণা প্রকল্প থেকে আহরিত জ্ঞান দেশের উন্নয়নের কাজে লাগানো হচ্ছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির উত্তরোত্তর উন্নয়নের জন্য বর্তমানে প্রায় সাড়ে-চারশত কোটি টাকার অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।

এ প্রকল্পের আওতায় দুইটি ১০তলা আবাসিক হল ও একটি ১০তলা একাডেমিক ভবন নির্মিত হবে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও অবোকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি সাধিত হবে। সমুদ্র ভিত্তিক অথনৈতিক কার্যক্রম (ব্লু -ইকোনমি) জোরদারকল্পে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ‘‘মেরিন সায়েন্স এন্ড রিসার্স ইনস্টিটিউট’’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ২০৪১ সালের ভিশন “উন্নত বাংলাদেশ” গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

পবিপ্রবি ক্যাম্পাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো ক্যাম্পাসের সৌর্ন্দয। এর প্রকৃতির অপরূপ শোভা আর দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো যে কোনো মানুষকেই বিমোহিত করবে। এ ক্যাম্পাসে রয়েছে সারি সারি নারিকেল গাছসহ হরেক রকমের গাছ-গাছালি। ক্যাম্পাসের ভেতরে রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিজ হাতে রোপন করা একটি সুন্দর বকুল গাছ। রয়েছে কয়েকটি প্রশস্ত লেক যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে। প্রশাসনিক ভবনের সম্মুখে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ভাস্কর্য ও মুর‌্যাল, ৭ বীরশ্রেষ্ঠের আবক্ষ ভাস্কর্য ও ‘জয়বাংলা’ নামে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ভাস্কর্য। ক্যাম্পাসটি দশর্নীয় স্থান হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক পর্যটক ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে ভিড় জমায়। প্রতি বছরের মত এ বছরও ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ (২২তম) আনন্দঘন পরিবেশে পালিত হবে।

হাজারো অর্জনের মধ্যেও আমাদের রয়েছে কিছু ব্যার্থতাঃ- ১. প্রিয় ক্যাম্পাস পবিপ্রবির প্রায় ২২ বছরে পদার্পন হতে চললেও এখনও এখানে বর্তমান বিশ্বের চাহিদা ভিত্তিক অনেক অনুষদ খুলতে পারি নি। ২. বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্লান না করে ভবন নির্মাণ করায় ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
৩. বিশ্ববিদ্যালয়টির ২১ বছরে নতুন ভূমি অধিগ্রহণ হয় নি। যার জন্য গবেষনাগার, একাডেমি ভবন নির্মাণ, বিনোদনের স্থানের সংকট বাড়ছে। ৪. ক্যাম্পাস আর হলের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ আর ইউনিয়নের বাজার। এটি দ্রুত অন্যত্র সড়িয়ে নেয়া দরকার। ৫. ছাত্রদের কল্যাণে শক্তিশালী এ্যালামনাই গড়ে উঠে নাই। ৬. বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় অফিসকক্ষ ও আসবাবপত্রের সংকট রয়েছে।
পরিশেষে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে পটুয়াখালীসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মননশীলতা, আধুনিকতায় দক্ষিণাঞ্চলের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। এ অঞ্চলের অতীত গৌরবকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আরও দৃঢ় ও সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণাঞ্চলের সত্যিকারের ‘বাতিঘর’ হয়ে উঠুক, এটা সবার প্রত্যাশা।

লেখকঃ- ডেপুটি রেজিস্ট্রার
পবিপ্রবি ইনোভেশন ডিসেমিনেশন সেন্টার
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ