৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বরিশালে বধিরদের মুখে কথা শেখায় যে স্কুল

শেয়ার করুনঃ

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email

রাহাদ সুমন,বিশেষ প্রতিনিধি॥ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জ্ঞানী-গুণীর চারণ ভূমি হিসেবে দেশের অন্যতম একটি উপজেলা বরিশালের বানারীপাড়া।অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী শের-ই-বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক,বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা মনোরমা বসু মাসীমা ও কুমুদ বিহারী গুহ ঠাকুরতা,৭১’র শহীদ বুদ্ধিজীবী ড.জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ও অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমদ্দার,স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও দেশবরেণ্য সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের জন্ম ও পূণ্যভূমি এ বানারীপাড়া। ধান-চালের ব্যবসার জন্যও প্রসিদ্ধ এ উপজেলা। এখানকার সন্ধ্যা নদীতে দেশের একমাত্র ভাসমান ধান-চালের হাটটি প্রায় দু’শ বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে।বরিশালকে বালাম চালের জন্য যে বিখ্যাত বলা হয় সেই বালাম চাল মূলত বানারীপাড়ায়ই প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। ইতিহাস সৃষ্টির ঐতিহাসিক পিঠ স্থান এ বানারীপাড়া ঐতিহ্য গর্ব- নিমগ্ন উজ্জ্বল জনতার মাঝে হঠাৎ একদিন কালবোশেখীর ঝড়ের মত এক শিক্ষকের ঘরে জন্ম নিলো একটি বধির শিশু । নাম রাখা হলো তার ‘লুবনা’। দু’চোখে তার শুধুই তৃষ্ণা। তার শিশু মুখের স্ফীত কালো শিরার রেখায় রেখায় বিশ্বের নির্বাক মানুষের অসহায় মানচিত্র। তার সর্বাঙ্গ অস্বিত্ব যেন প্রেতচ্ছায়ার কথাহীন সংলাপের ঘোষনার প্রতিধ্বনি তুলে বলছে …”তোমাদের এ হাসির খেলা সাঙ্গ হোক, কারন আমি তোমাদেরই লোক”।তোমরা কথা বলছো, গর্ব অনুভব করছো আর তোমাদের সন্তান হয়েও আমাকে বোবা আখ্যায়িত করে মনুষ্য সমাজ থেকে আলাদা করে রেখেছো । এ লজ্জা ঢাকার মিথ্যে উৎসবে তোমাদের কি লাভ? আমিও কথা বলতে চাই তোমাদেরই মত।কারন “বধির অর্থ মূক নয়, উপযুক্ত সহায়তা পেলে আমিও কথা বলব”। তাই- “এই কন্ঠে শুধু একটি বার রাখ হাত তবে নিশ্চয় নির্বাক আমি ফিরে পাব বাক”। লুবনার এ অব্যক্ত অভিব্যক্তিতে ছিলো অনন্ত জিজ্ঞাসা।বেদনাহত কন্ঠে প্রলয়ংকারী ঝড়ের অশনি সংকেত যেন ধ্যানভূক ক্রৌঞ্চীর হৃদয় মথিত কান্নায় তরঙ্গায়িত বিষাদ সিন্ধু,দুধ-রাজ সাপের ফলার মত দুলছে ধ্যান মগ্ন বাল্মীকির দৃষ্টির সম্মূখে ঐতিহ্য গর্বিত বানারীপাড়া বাসীর হৃদয় রনিয়ে উঠল অনাদী কালের বিরহ বেদনার করুন রাগিনী।বানারীপাড়ার ধারালিয়া গ্রামের শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী অধ্যাপক তারিকুল ইসলাম খানের প্রচেষ্টায় ঢাকা হাইকেয়ার সোইসাইটি ও এ অঞ্চলের অসহায় মানুষের মূখ্যপাত্র নবীন সংঘের যৌথ উদ্যোগে ১৯৮৪ সালের ২৮ মার্চ থেকে তিনদিন ব্যাপী বাংলাদেশের “প্রথম বধির ক্যাম্প” অনুষ্ঠিত হয় বানারীপাড়ায়। আ. হাই বখ্শ’র উদ্যোগে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে খবর পেয়ে ঢাকার বিক্রমপুর সহ দক্ষিন বাংলার আনাচে কানাচে থেকে ক্যাম্পে আসে ১০৮ জন বধির। এ জনপদে জাগলো প্রানের স্পন্দন। পরে ওই বছরের মে মাসে হাইকেয়ার সোসাইটি ঢাকা থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে আ.হাই বখ্শ বধির স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালান। তার একক প্রচেষ্টায় এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১৯৮৪ সালের ৫ ও ৬ ডিসেম্বর বানারীপাড়ায় পূনরায় অনুষ্ঠিত হয় বধির ক্যাম্প। ঢাকা থেকে ক্যাম্পে আসেন বিট্রিশ নাগরিক ও বাংলাদেশ হাইকেয়ার সোসাইটির বিশেষজ্ঞ মনিকা জে.তমলিন। তার সনাক্ত করা ১২ টি বধির ছেলে-মেয়ে আর তাদের জন্য হাইকেয়ার সোসাইটির পক্ষে তাঁর দেওয়া ১২টি হিয়ারিং এইড নিয়ে আ. হাই বখ্শ বানারীপাড়া উপজেলা সদরে বরিশাল-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. শাহে আলমের বাড়িতে খোলা উঠানে একটি আমড়া গাছের তলায় শুরু করেন বধিরদের কথা শেখানোর দুঃসাহসিক কার্যক্রম। এরপর লুবনা সহ ওই ১২ নির্বাক শিশুকে নিয়ে বানারীপাড়া রাজ্জাকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীণ প্রধান শিক্ষক আ. হাই বখ্শের পরিচালনায় ‘নির্বাক শিশুকে সবাক করাই উদ্দেশ্য এবং বধির অর্থ মূক নয়’ উপযুক্ত সহায়তা পেলে সেও কথা বলতে পারবে এ স্লোগানকে সামনে রেখে ১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর বধিরদের কথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানারীপাড়া হাইকেয়ার স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। এর ফলে অবহেলিত গ্রামীন বধিরেরা কথা বলার আশা দেখতে পায়। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ হাইকেয়ার সোসাইটি বানারীপাড়ায় বধিরদের কথা শেখানোর এ কার্যক্রমকে “হাইকেয়ার স্কুল বানারীপাড়া” নামে তার একটি শাখা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এস.এম ইকবাল ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী গোলাম মওলার প্রস্তাবে হাইকেয়ার স্কুলের জন্য বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন(পাইলট) দান করে ১৯ শতাংশ জমি। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আ্যাডভোকেট এস. এম. ইকবালের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মিত ছোট আকারের নিজস্ব একতলা ভবনে শুরু হয় হাইকেয়ার স্কুলের নবযাত্রা।খোলা আকাশের নিচে ১২টি বধির শিশু আর একজন মাত্র শিক্ষক (আঃ হাই বখ্শ’কে) নিয়ে শুরু করা স্কুলটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ইতোমধ্যে সাড়ে তিন দশক অতিক্রম করেছে । শহরের ব্যয় বহুল সুযোগ যাদের নাগালের বাইরে সেই দক্ষিন বাংলার গ্রামীন অসহায় আড়াই শতাধিক বধির এখান থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছে।চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত দেড় শতাধিক বধির ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে পুর্নাঙ্গ কথা শিক্ষা ও লেখাপড়া শিখে বিদায় নিয়েছে ৬৪ জন। বিদায়ীদের মধ্যে ৪৫ জন বধির নরমাল স্কুল ভর্তি হয়েছে। গ্রামীন যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, আবাসিক সমস্যা ও আর্থিক সংকট সহ বিভিন্ন কারনে অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রী (৬৪ জন) ঝড়ে গেছে। বিদায়ী ছাত্রী দীপালি, জোসনা, বিউটি, কাজল, বিথীকা, পলি, রাবু এবং ছাত্র জাহাঙ্গীর আলম, জাহাঙ্গীর হোসেন, জীবন, ভোলা, জুয়েল, অপুরা স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রী এবং স্বাভাবিক সন্তান নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আহাদ, রাজু, উর্মি, নাজমা, বাবুরা নরর্মাল স্কুলে পড়াশুনা শেষ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। আর যাকে কেন্দ্র করে হাইকেয়ার স্কুল বানারীপাড়ার সৃষ্টি সেই লুবনাও ১৯৯৯ সালে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পাশ করে স্বাভাবিক স্বামী সন্তান নিয়ে জীবন যাপন করছিল। কিন্তু জীবন যাদের দুঃখে গড়া, তাদের আবার দুঃখ কিসের! রানী বড়াল, বিউটি বড়াল, নাজমা, আরজু পপি আর লুবনাদের সংসার টিকলোনা। লুবনা তার এক মাত্র মেয়ে সন্তান নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তার পৈত্রিক সংসারেই রয়েছে। তবে সেই লুবনা তার সংসার ভাঙ্গার আগে থেকেই হাইকেয়ার স্কুলের সেলাই ও ছবি আঁকার শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত রয়েছে। বর্তমানে মোট ৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা দ্বারা পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ৩০ জন বধির ছাত্র-ছাত্রী কথা বলা ও লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় প্রতিষ্ঠার সাড়ে তিন দশকেও এ স্কুলটি সরকারি অনুমোদন পায়নি। ব্যক্তির অনুদানে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। চারজন শিক্ষক এবং একজন আয়ার বেতনভাতা দেওয়ার সঙ্গতি নেই। ২০০৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য মোঃ মনিরুল ইসলাম মনি’র যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বড় বোন সাংবাদিক নার্গিস রফিকা রহমান স্কুল ভবনের অসমাপ্ত অর্ধাংশের নির্মান কাজ সমাপ্ত করে দেওয়ায় শ্রেণী কক্ষের অভাব দূর হলেও এ মুহুর্তে জরুরী ভাবে প্রয়োজন দূর- দূরাঞ্চল থেকে আগত ছাত্র- ছাত্রীদের জন্য ছাত্রাবাস নির্মান করা। প্রয়োজন হিয়ারিং এইড সহ বিবিধ যন্ত্রপাতি ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় বহুল শিক্ষা উপকরন।খুঁিড়য়ে খুঁড়িয়ে এভাবে স্কুলটি কতদিন চলতে পারবে কে জানে। স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে গ্রাম-গঞ্জের বধিররা কথা শেখা থেকে বঞ্চিত হবে।সমাজ, জনগন, সাহায্য সংস্থা ও রাষ্ট্র সাহাযে-সহায়তার হাত নিয়ে এগিয়ে না আসলে বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র গ্রামীন (উপজেলা) পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবী এ প্রতিষ্ঠানকে বাাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিনের দাবি, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের কথা শেখানোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে অ্যাপিলেশন ঘোষণার।দেশে বর্তমানে ২.৬% বাক শ্রবণ প্রতিবন্ধী।বাংলাদেশের সব ক’টি হাইকেয়ার স্কুল ধুঁকেধুঁকে চলছে।কেবল অ্যাপিলেশনের ঘোষণায় স্কুলগুলো বেঁচে যেতে পারে।

সর্বশেষ